Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
সেঞ্চুরিতেও সঙ্গী সংশয়

বৈঠকবিলাসে ব্রাত্য শিল্পায়ন

স্কুল বসেছে। সার্কিট হাউসের হলঘরে। দিদিমণি রোলকল শুরু করলেন। ছাত্রেরা কেউ বিডিও, কেউ মহকুমাশাসক, কেউ অতিরিক্ত জেলাশাসক। কেউ বা খোদ জেলাশাসক। আর দিদিমণি? তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জেলার প্রশাসনিক বৈঠকের জন্য যিনি কিনা নবান্ন উজাড় করে মন্ত্রী-আমলাদের নিয়ে এসে বসিয়েছেন ক্লাসঘরে। বিভিন্ন জেলায় ঘুরে ঘুরে তাঁর এমন ক্লাস চলে। কী রকম? দিদিমণি হাঁকলেন, বিডিও-রা কে কে আছেন? এক এক করে দাঁড়ান। নাম বলুন।

মমতার ৯৮তম প্রশাসনিক বৈঠক। ১ জুলাই বহরমপুরে। — ফাইল চিত্র

মমতার ৯৮তম প্রশাসনিক বৈঠক। ১ জুলাই বহরমপুরে। — ফাইল চিত্র

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ১৫ জুলাই ২০১৫ ০৩:৫৫
Share: Save:

স্কুল বসেছে। সার্কিট হাউসের হলঘরে।
দিদিমণি রোলকল শুরু করলেন। ছাত্রেরা কেউ বিডিও, কেউ মহকুমাশাসক, কেউ অতিরিক্ত জেলাশাসক। কেউ বা খোদ জেলাশাসক। আর দিদিমণি?
তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জেলার প্রশাসনিক বৈঠকের জন্য যিনি কিনা নবান্ন উজাড় করে মন্ত্রী-আমলাদের নিয়ে এসে বসিয়েছেন ক্লাসঘরে। বিভিন্ন জেলায় ঘুরে ঘুরে তাঁর এমন ক্লাস চলে।
কী রকম? দিদিমণি হাঁকলেন, বিডিও-রা কে কে আছেন? এক এক করে দাঁড়ান। নাম বলুন। ...আপনার ব্লকে আইসিডিএসের কাজ কেমন হচ্ছে? মিড-ডে মিলের স্কুলগুলো শেষ কবে ইন্সপেকশন করেছেন? কোনও দিন মিড-ডের খাবার খেয়ে দেখেছেন? একশো দিনের কাজে ক’জন কাজ পেয়েছেন?
ঝাঁকে ঝাঁকে প্রশ্ন উড়ে আসে। প্রশ্নকর্ত্রীর ভাবনার সঙ্গে উত্তর মিলে গেলে বাঁচোয়া। নচেৎ রক্ষে নেই। কড়া ধমক কপালে নাচছে। কারণ, মুখ্যমন্ত্রী রাস্তায় নেমে যা দেখে-শুনে এসেছেন, সেটাই বেদবাক্য। ‘‘আপনি বললেই শুনব? এই তো আমার কাছে হিসেব রয়েছে। আপনার হিসেব মিথ্যে...।’’
ধমকের আঁচে কখনও বিডিও পোড়েন, কখনও এসডিও, কখনও ডিএম-এডিএম, মায় বিভাগীয় সচিব, এমনকী মন্ত্রী। বাদ যান না দলের জেলা-নেতারাও। তাই দিদি বৈঠক করতে আসছেন শুনলেই ঘাড় গুঁজে হোমওয়ার্কে ব্যস্ত হয়ে পড়েন জেলার বড়-মেজো-ছোট কর্তারা।

চার বছর আগে মুখ্যমন্ত্রী পদে আসীন হয়ে তৃণমূলনেত্রী এ ভাবেই দৌড় শুরু করেছিলেন। মন্ত্রী-সান্ত্রি-পারিষদ নিয়ে জেলায়-জেলায় মানুষের দরজায় পৌঁছে যাওয়ার দৌড়। ৯৯টি হয়ে গিয়েছে। আজ, বুধবার শততম বৈঠকের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে তিনি। পঞ্চাশ মাসে একশোটি বৈঠক! প্রতি বলে দু’রানের মতো!

তাঁর পূর্বসূরিরা বলতেন, রাইটার্সে বসে রাজ্য চালাবেন না। কংগ্রেস আমলে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় জেলায় জেলায় মন্ত্রিসভার বৈঠক শুরু করেছিলেন। যদিও তা ধরে রাখা যায়নি। বাম জমানায় জ্যোতি বসুর ঘোষণা ছিল, তাঁরা শুধু রাইটার্স থেকে সরকার পরিচালনা করবেন না। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ও জেলা পরিষদের হাতে বহু ক্ষমতা তুলে দিয়েছিল তাঁর সরকার। বসু ও তাঁর উত্তরসূরি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য জেলায় বৈঠক করলেও তার সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। সে দিক থেকে মমতা সকলকে ছাপিয়ে গিয়েছেন। উপরন্তু তাঁর জেলা সফরে প্রশাসনিক বৈঠকের অঙ্গাঙ্গী হয়ে থাকে জনসভা, যেখান থেকে তিনি দান-খয়রাতির প্রসাদ বণ্টন করে থাকেন।

এবং মুখ্যমন্ত্রী মনে করেন, এতে ভাল বই মন্দ হয়নি। কাজে গতি এসেছে। প্রশাসনে নড়াচড়া বেড়েছে। কড়া নজরদারির দরুণ আধিকারিকদের মধ্যে দায়বদ্ধতা এসেছে। কিছু আমলা-মন্ত্রীও বলছেন, এর সুবাদে সদর অফিসের সঙ্গে জেলার যোগাযোগ বেড়েছে। এত যাতায়াতের ফলে মুখ্যমন্ত্রীর নিজস্ব ‘নেটওয়ার্ক’ তৈরি হয়েছে, যার দৌলতে প্রশাসনের নীচের স্তরের অফিসারের সঙ্গেও তিনি সরাসরি কথা বলতে পারছেন।

কিন্তু ওই সব বৈঠকে প্রকল্প ঘোষণা বা ডোল বিলি হলেও স্থায়ী সম্পদ তৈরি হচ্ছে কি?

প্রশাসনেরই একটি বড় অংশে প্রশ্নটা এখন প্রকট। এই মহলের বক্তব্য: রাজ্যকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে স্থায়ী সম্পদ তৈরি করা জরুরি। এ জন্য নিত্য-নতুন শিল্প ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। মমতার সরকার সে কাজে আদৌ সফল কিনা, এবং হলেও কতটা সফল, মুখ্যমন্ত্রীর শততম বৈঠকের মুখে প্রশ্নটা অনেককে নতুন করে ভাবাচ্ছে। উপরন্তু ওই সব বৈঠকের আয়োজন করতে গিয়ে সরকারি কোষাগারের টাকা খরচ হচ্ছে অকাতরে। যেমন, আজকের বর্ধমান বৈঠকের পিছনে প্রায় ৮৫ লক্ষ টাকা বরাদ্দ হয়েছে বলে প্রশাসনিক-সূত্রের খবর। খয়রাতির ঘোষণা তো আছেই। দেখে-শুনে আমলা মহলের একাংশ বিস্মিত। স্থায়ী সম্পদ সৃষ্টিতে নজর না-দিয়ে এ ভাবে সম্পূর্ণ অনুৎপাদক খাতে টাকা খরচের যৌক্তিকতা তাঁরা খুঁজে পাচ্ছেন না। খাস নবান্নের এক কর্তার পর্যবেক্ষণ, ‘‘মঞ্চ থেকে সাইকেল, পাট্টা, গরু-মোষ বিলি করলে মানুষ সাময়িক খুশি হয়। এতে হাততালিও জুটলেও রাজ্য এগোবে না। গ্রামের কর্মক্ষম ও শিক্ষিত মানুষের কাছে এই দান-খয়রাতি অনেকটা ত্রাণ বিলির মতো। তাঁরা চান, পাকা রাস্তার সঙ্গে পাকা চাকরির নিয়োগপত্র।’’

তবে প্রশাসনের একাংশের দাবি, মুদ্রার অন্য পিঠের মতো মুখ্যমন্ত্রীর ঘন ঘন সপার্ষদ জেলা সফরের অনেক ইতিবাচক দিকও রয়েছে। কী রকম?

ওঁদের ব্যাখ্যা: এতে গ্রামীণ রাস্তা, পানীয় জল, বিদ্যুৎ, সেতু-কালভার্ট বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র-স্কুল-কলেজ তৈরির মতো পরিকাঠামো উন্নয়নের কাজ গতি পেয়েছে। সামগ্রিক ভাবে গ্রাম-বাংলার চেহারা অনেকটা ফিরেছে। সরকারি বাড়িতে রংয়ের প্রলেপ আর রাস্তায় আলোর ঝকমারিতে জেলা শহরগুলিতে শ্রী এসেছে। পরিষেবা ব্যবস্থাও আগের চেয়ে ভাল হয়েছে।

বস্তুত একাধিক ডিএম এবং বিডিও’র অভিজ্ঞতা বলছে, মুখ্যমন্ত্রীর কাছে জবাবদিহির ভয়ে এখন সময়সীমা মেনে কাজ করার চেষ্টা হচ্ছে। অফিস-কাছারিতে কর্মী ইউনিয়নের দাপাদাপি কমেছে। আগে জেলার প্রকল্পে অর্থ দফতরের বরাদ্দ পেতে বছর ঘুরে যেত। এখন খোদ অর্থমন্ত্রীও তেমন ঢিলেমি দেখানোর সাহস পান না।

অর্থাৎ সব মিলিয়ে প্রশাসনিক কর্তাদের দায়বদ্ধতা বেড়েছে, নবান্নের সঙ্গে জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে সমন্বয় দৃঢ়তর হয়েছে। ‘‘আগের সরকার টাকাই খরচ করতে পারত না। এখন সেই সমস্যা অনেকটা কম।’’— বলছেন নবান্নের এক কর্তা। কারও কারও দাবি, বাম আমলে ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের মাধ্যমে কাজ করতে গিয়ে দলীয় অনুশাসনের ঠেলায় উন্নয়ন পদে পদে ধাক্কা খেত। এই মুখ্যমন্ত্রী দলকে পাশে সরিয়ে একেবারে তৃণমূলস্তরে প্রশাসনের হাতে যাবতীয় ক্ষমতা তুলে দেওয়ায় সুফল মিলছে বেশি।

কিন্তু এই কড়াকড়িতে কোথাও কোথাও উল্টো ফলও ফলছে বলে আক্ষেপ রয়েছে প্রশাসনের কিছু মহলে। অনেকের মতে, প্রশাসনের অন্দরে গজিয়ে উঠেছে ভয় ও আতঙ্কের পরিবেশ। কিছু জেলার অফিসারেরা জানাচ্ছেন, মুখ্যমন্ত্রীর বেঁধে দেওয়া সময়সীমা আর প্রশাসনের উপরওয়ালাদের চাপ সামলাতে গিয়ে কাজের গুণমানের সঙ্গে আপস করা ছাড়া উপায় থাকছে না, কাজের মানের বদলে সংখ্যাই বিচার্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রীকে খুশি করার তাগিদে একশো দিনের কাজ, ইন্দিরা আবাস যোজনা, পুকুর কাটা, বিভিন্ন ভাতা-প্রকল্পে কারচুপি করে উপভোক্তার সংখ্যা বাড়িয়ে দেখানোর অভিযোগও শোনা গিয়েছে বিরোধীদের মুখে।

পাশাপাশি প্রশ্ন উঠেছে মুখ্যমন্ত্রীর জেলা সফরের বিপুল আয়োজনের বহর নিয়ে। অনেকের দাবি, সফরের অন্তত দশ দিন আগে থেকে জেলার প্রশাসনিক কাজকর্ম লাটে ওঠে, আমজনতার ভোগান্তির শেষ থাকে না। প্রকল্প ঘোষণার হিড়িক দেখেও কটাক্ষ করছেন কেউ কেউ। তাঁদের অভিযোগ, জেলা সফরে মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষিত বহু প্রকল্পেরই অস্তিত্ব পরে খুঁজে পাওয়া যায় না। কিছু কর্তার অভিজ্ঞতা, জনসভার মঞ্চে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী যে সব দাবি করেন, অনেক ক্ষেত্রে সরকারি তথ্যের সঙ্গে তা মেলে না! যেমনটা হয়েছিল ২০১২-র ১২ জানুয়ারি, ঝাড়গ্রামের জনসভায়। সে দিন মুখ্যসচিবের মুখ দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী যা দাবি করেছিলেন, তা ঠিক নয় বলে অভিযোগ ওঠে প্রশাসনেরই অন্দরে।

বিভিন্ন প্রশাসনিক বৈঠকে কাজের খতিয়ানের প্রসঙ্গে বিভিন্ন আমলা মুখ্যমন্ত্রীর রোষের মুখে পড়েছেন। নিচুস্তরের অফিসারদের সামনে মুখ্যমন্ত্রী যে ভাবে আমলা বা মন্ত্রীদের ভর্ৎসনা করে থাকেন, তা নিয়েও ক্ষোভ জমেছে। নবান্ন-সূত্রের খবর: ক’দিন আগে বহরমপুরে ৯৮তম বৈঠকে তৃণমূলের এক সাংসদ অভিযোগ করতে গেলে সকলের সামনেই মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে ধমক দিয়ে বলেন, ‘এটা দলের বৈঠক নয়। এখানে এ সব বলা যাবে না।’ বৈঠকে বসে বিডিও-র অভিযোগ পেয়ে মুখ্যমন্ত্রী ডিএম’কে তুলোধনা করেছেন— এমন উদাহরণেরও কমতি নেই।

পাশাপাশি কোনও নিয়ম-নীতি, শৃঙ্খলার তোয়াক্কা না-করে বৈঠকে বসেই আইএএস, আইপিএসদের বদলির নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। যেমন এক বার প্রশাসনিক বৈঠকের সময় ছুটি নিয়ে বিদেশে থাকায় বদলি হতে হয়েছিল তদানীন্তন কারিগরি শিক্ষা-সচিব হৃদেশমোহন ও পঞ্চায়েত-সচিব বরুণ রায়কে। পানাগড়ের রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ কেন ‘পয়সা খায়’, বৈঠকে সে প্রশ্ন তুলে আসানসোলের তৎকালীন পুলিশ কমিশনারকে পত্রপাঠ বদলি করা হয়েছিল বলে অভিযোগ। ২০১৩-য় দক্ষিণ দিনাজপুরের বুনিয়াদপুরে সভা করতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ট্রাফিক জ্যামে আটকে প়ড়েছিলেন। তাঁকে তিন কিলোমিটার হেঁটে সভাস্থলে পৌঁছতে হয়। এসপি’র বদলির অর্ডার বেরোতে দেরি হয়নি। ২০১২-য় দিঘায় মৎস্য দফতরের অতিথিশালায় আয়োজিত প্রশাসনিক বৈঠকে একশো দিনের কাজ নিয়ে অভিযোগ ওঠায় সভার মধ্যেই তৎকালীন ডিএম’কে ভর্ৎসনা করেন মমতা। পরে তাঁকে বদলিও করে দেওয়া হয়।

এর মধ্যেও ইতিবাচক দিক দেখছে প্রশাসনের একটা বড় অংশ। যাদের মত, কখনও ছোটদের সামনে বড়দের ধমক, এমনকী বদলির নির্দেশ দেওয়াটা অস্বস্তিকর হলেও মুখ্যমন্ত্রী আসলে বার্তা দিচ্ছেন যে, কাজের ত্রুটি দেখলে তিনি কাউকে রেয়াত করেন না। ওই মহলের দাবি, এতে প্রশাসনিক কর্তাদের দায়বদ্ধতা বাড়ছে।

কিন্তু ঘটনা হল, চার বছরে একশোটা বৈঠকে পরিষেবা ও কেন্দ্রের টাকায় পরিকাঠামো তৈরির দিকে যতটা নজর দেওয়া হয়েছে, তার সিকিভাগও নজর কাড়েনি শিল্প। পর্যবেক্ষণ বলছে, জেলায় জেলায় শিল্পের জন্য জমি-পরিকাঠামো-পরিবেশ তৈরি করে রাজ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যে উদ্যোগ দরকার ছিল, মুখ্যমন্ত্রী তাকে কখনই অগ্রাধিকারের তালিকায় রাখেননি। তাই এত দৌড়েও স্থায়ী সম্পদ তৈরিতে পাসমার্ক তুলতে পারেনি মমতার সরকার।

তা হলে কর্মসংস্থানের কী হবে?

চলতি অর্থবর্ষের বাজেট পেশ করে রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র দাবি করেছেন, গত চার বছরে পশ্চিমবঙ্গে ৪৩৫টি শিল্প-প্রকল্প তৈরি হয়েছে বা তৈরির প্রক্রিয়া চলছে। এতে ৮৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে বা হবে। কর্মসংস্থান হবে ২ লক্ষ ২৯ হাজার। অন্য দিকে বিরোধীদের দাবি, এই আমলে কোনও বড় শিল্প-প্রকল্প দিনের আলো দেখেনি। যেটুকু বিনিয়োগ হয়েছে, প্রায় সবই যাত্রা শুরু করেছিল বাম জমানায়। পাশাপাশি রাজনৈতিক বিরোধী মহল তো বটেই, শিল্প-বাণিজ্য মহলেরও বড় অংশের অভিযোগ: কর্মসংস্থান প্রসঙ্গে সরকারের শীর্ষ স্তর থেকে নানান বিভ্রান্তিকর তথ্য আসছে। গল্পের গরু গাছে ওঠার মতো ১০ লক্ষ কর্মসংস্থানের দাবিও করা হচ্ছে!

বাস্তবে কার্যত এ সব অভিযোগেরই প্রতিফলন। আমেরিকা-লন্ডন-সিঙ্গাপুর-মুম্বই-দিল্লি সহ কলকাতায় একাধিক শিল্প সম্মেলন করেও গুটি কয়েক প্রকল্পের সম্প্রসারণ ও কিছু মাঝারিমানের শিল্প-বিনিয়োগ ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের পাতে দেওয়ার মতো কিছু নেই। উল্টে একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়ে ছবিটা আরও বিবর্ণ করে তুলছে। ঐতিহ্যশালী জেসপ ও হিন্দমোটর কারখানা, শালিমার পেন্টস, নোকিয়া সিমেন্ট, খৈতান পাখা কিংবা পানাগড়ে ম্যাট্রিক্স সংস্থার সম্প্রসারণ প্রকল্প এই আমলেই বন্ধ হয়েছে। পশ্চিম মেদিনীপুরে চার বছরে অন্তত আটটি কারখানা বন্ধ হয়ে কাজ হারিয়েছেন প্রায় ৬৫০০ লোক। শততম বৈঠক হচ্ছে যে জেলায়, সেই বর্ধমানে ছোট-মাঝারি মিলিয়ে মোট ১০৪টি ইস্পাত ও স্পঞ্জ আয়রন কারখানার মধ্যে ২০টির ঝাঁপ বন্ধ, ধুঁকছে ৩৫টি। বন্ধের তালিকায় রয়েছে হলদিয়ার কয়েকটি কারখানা। বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে ফেরো অ্যালয়ও পাট গুটিয়েছে।

কেন এই দশা?

বণিকসভাগুলির মতে, উত্তরটা লুকিয়ে রয়েছে মমতা সরকারের নীতি ও ভাবমূর্তির মধ্যেই। তাদের ব্যাখ্যা, শিল্পের জন্য এই সরকার জমি অধিগ্রহণ করবে না। সরকারের পরামর্শ: বিনিয়োগকারীরা জমি কিনে শিল্প গড়ুক। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে বহুধাবিভিক্ত জমি যে কোনও একটি সংস্থার পক্ষে কেনা সম্ভব নয়, সেই সারসত্যটা সরকার বুঝতে পারছে না। তা ছাড়া জমি কিনতে গিয়ে বহু জায়গায় শাসকদলের স্থানীয় নেতা-কর্মীর জুলুমের মুখে পড়তে হচ্ছে দেখেও সরকার নিরুত্তাপ। পরিণামে অনেক সংস্থা কিছু দূর এগিয়েও হাত তুলে দিয়েছে। কেউ কেউ প্রকল্প গড়ার ভাবনাই ছেড়েছে। প্রশাসনের একাংশও মনে করে, সিন্ডিকেট-রাজ ও তোলাবাজি এ রাজ্যে শিল্প গড়ার পথে অন্যতম অন্তরায়। ‘‘নতুন শিল্প তো দূরের কথা, রুলিং পার্টির হরেক গোষ্ঠীর তোলাবাজির দাপটে অনেকে মাঝ পথে পাততাড়ি গুটিয়েছে। এখানে সিন্ডিকেটই শিল্প। সেখানে কোটি কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে।’’— মন্তব্য এক আধিকারিকের।

ফলত বিনিয়োগে খরা। শিল্প দফতরের খবর: রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগমের অধীনস্থ যে ২২টি শিল্পপার্ক, বারবার বিজ্ঞাপন দিয়ে সেখানেও লগ্নি মিলছে না। পার্কের প্রায় তিন হাজার একর ফাঁকাই পড়ে রয়েছে। যদিও সরকারের একাংশের দাবি: লগ্নি টানতে ভূমি-আইনের ১৪ওয়াই ধারা সংশোধন করে বহু ক্ষেত্রকে সিলিংয়ের বেশি জমি রেখে শিল্প করার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। শিল্পের জন্য আবেদন করার নিয়ম-পদ্ধতি অনেক সরল করা হয়েছে। তবে মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসনিক বৈঠকের সূচিতে সংশ্লিষ্ট জেলার শিল্প-পরিস্থিতি যে বিশেষ জায়গা পায় না, মোটামুটি সকলেই তা মানছেন।

শততম বৈঠকের প্রাক্কালে রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঘিরেও প্রশ্ন। পুলিশি তথ্যই বলছে, শুধু গত ছ’মাসে রাজ্যে খুন হয়েছেন ৫৬৯ জন। নারী নিগ্রহ, রাজনৈতিক সংঘর্ষ, শাসকের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ও পুলিশের উপরে শাসকদলের অনুগামীদের হামলার ঘটনা বেড়েই চলেছে। এমতাবস্থায় নবান্নের একাধিক কর্তার প্রশ্ন, ‘‘মানুষের নিরাপত্তার বিষয়টিকে বাদ দিয়ে কি উন্নয়ন সম্ভব?’’

বৈঠকের সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে স্থায়ী সম্পদ তৈরি করা না-গেলেও কিছু কিছু পরিকাঠামো উন্নয়নের কাজ অবশ্য হয়েছে। আলো, রঙে রূপটান লেগেছে শহরে শহরে। কোথাও কোথাও পার্ক-ফোয়ারায় জেল্লা বেড়েছে। যা দেখে আবার কেউ কেউ বলছেন, ‘‘নেই মামার চেয়ে কানা মামাই বা খারাপ কী!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE