Advertisement
E-Paper

রঙিন বোতল আর মিক্সচারে জমাট আসর, টান সিগারেটে

রাত ১১টার তারকেশ্বর লোকাল। ভেন্ডারের ঠিক পরের কামরা। ছানার জলের কটূ গন্ধে বাতাস ভারী। ভিড়ে খামতি নেই। জানলার ধারে বসার জন্য বড়দের হুটোপাটি। মহিলা যাত্রীদের সংখ্যা চোখে পড়ার মতো। তাঁদের মধ্যে কেউ পরিবারের সঙ্গে। কেউ বা একা।

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৬ মে ২০১৫ ০০:৫৭

রাত ১১টার তারকেশ্বর লোকাল। ভেন্ডারের ঠিক পরের কামরা। ছানার জলের কটূ গন্ধে বাতাস ভারী।

ভিড়ে খামতি নেই। জানলার ধারে বসার জন্য বড়দের হুটোপাটি। মহিলা যাত্রীদের সংখ্যা চোখে পড়ার মতো। তাঁদের মধ্যে কেউ পরিবারের সঙ্গে। কেউ বা একা।

ট্রেন ছাড়তেই ভেন্ডারের দিকে বসার টানা লম্বা সিটটার জানলার দিকের মাঝবয়েসী দুই যাত্রী নড়েচড়ে উঠলেন। ছোট্ট ঝুড়ি গামছা দিয়ে ঝুলিয়ে এক যুবকও প্রতিদিনের মতো হাজির ‘মিক্সচার’ নিয়ে। বাদাম, ঝুড়িভাজা, পেঁয়াজ, লঙ্কা আর টক দিয়ে এই মণ্ড রেলযাত্রীদের পরিভাষায় ওই নামেই পরিচিত।

‘মিক্সচারওয়ালা’কে দেখে মাঝবয়সীদের উত্‌সাহ বাড়ে। তারা বলে উঠলেন, “কী ব্যাপার আজ সন্ধ্যাতেই সব ঘুমোলি না কি?” পাল্টা উত্তর এল, “না ওস্তাদ, আমরাও তো সেটাই ভাবছিলাম। তোমরা শুয়ে গেলে না কি? মিক্সচার এসেছে?” জবাব গেল, “এসেছে কি রে? শেষ হতে চলল।”

কথার মাঝেই হাতেহাতে ঘুরতে শুরু করল একটা সবুজ রঙের ঠান্ডা পানীয়ের বড় বোতল। ভিতরের তরলের জন্য তার রঙটা ঈষৎ কালচে। ‘মিক্সচার’-সহ ঠোঙা আর সেই বোতল হাতেহাতে ঘুরতে লাগলো। এক মাঝবয়সী বলে উঠলেন, ‘‘আজ বড় কড়া করে ফেলেছিস রে বাচ্চা। গলা জ্বলিয়ে নামছে। পরেরটায় জলটা একটু বেশি দিস। ঠান্ডা জল আছে তো?’’ উত্তর এল, “ঠিক হ্যায় ওস্তাদ। প্রথমটা কড়া না হলে ‘ঝিটটা’ (আমেজ) ভাল আসবে না।” বললেন যিনি, তিনি দাঁড়িয়ে ‘অফ-সাইডে’ (যে দিকে সাধারণত প্ল্যাটফর্ম পড়বে না)।

কথাবার্তার ফাঁকেই হাত পড়ল সিগারেটের লাইটারে। এক জন এক মনে সিগারেটের ধোঁয়ার রিং ছেড়ে চলেছেন। সেই রিং জানলার পাশের তরুণীর মুখের কাছে গিয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। ধোঁয়ায় আড়াল খুঁজতে রীতিমতো নাকে রুমাল চাপা দিয়ে বসতে বাধ্য হলেন তরুণী। ট্রেন ততক্ষণে গতি বাড়িয়ে ছুটছে লিলুয়া স্টেশন অভিমুখে। জমে উঠেছে রাতের উল্লাস।

হাওড়া স্টেশনের নিত্যযাত্রীদের কাছে রেলের কামরাকে প্রায় বারের চেহারায় পৌঁছে দেওয়ার এই ছবিটা ভীষণ চেনা। শুধু ভেন্ডার লাগোয়া কামরা নয়, অন্য কামরাতেও তিন-চার জনের দলে ভাগ হয়ে নানা অনুপান-সহ এই মদ্যপান এখন প্রায় প্রতিদিনের রেওয়াজ।

এক সময় লোকাল ট্রেনে জলের বোতলে মিশিয়ে লুকিয়ে-চুরিয়ে মদ খাওয়া চলত নিয়ম করে। কেউ কেউ ভেন্ডার কামরায় জিনিসপত্রের ভিড়ে আড়াল খুঁজে নিতেন। কিন্তু এখন কোনও রাখঢাক নেই। পুরোটাই খোলাখুলি। নিত্যযাত্রীদের একটা বড় অংশের অভিজ্ঞতা, শুধু তারকেশ্বর লোকাল নয়, হাওড়া স্টেশন থেকে রাত সাড়ে ৯টার পরে ছাড়া কম-বেশি সব ট্রেনে নিয়ম করে এ সব চলে। হাওড়া স্টেশন চত্বরে, ট্যাক্সিস্ট্যান্ড লাগোয়া খাবারের দোকানে, বাসস্ট্যান্ডের ছোট কাঠের গুমটিগুলো থেকেই মেলে নানা ব্র্যান্ডের মদের নানা মাপের ‘বোতল’। স্টেশনের স্টলগুলো থেকে অনেকে একটু বেশি ঠান্ডা জলের বোতল কেনেন। যাতে চলন্ত ট্রেনে অনেকক্ষণ ধরে ঠান্ডা জলের যোগান থাকে।

ট্রেনেই এই মজলিস কেন?

নিয়মিত এই আসরে যোগ দেওয়া একাধিক জনের বক্তব্য, “বারে গেলে খরচ বেশি। সময় বেশি লাগে। তার মধ্যে বাড়ি থেকে তাগাদা দিয়ে ফোন আসে। ট্রেনে প্রোগ্রাম (মজলিস) হলে সে ঝক্কি নেই। বাড়িতেই তো যাচ্ছি।’’ কিন্তু প্রকাশ্যে এ ভাবে মদ্যপান, ধূম্রপান করতে গিয়ে আইন ভাঙার কথা মাথায় আসে না? জবাব আসে, ‘‘কত লোকে কত আইন ভাঙছে, সে সব কে দেখে বলুন তো?’’

ঘটনা হল, নিত্যযাত্রীদের অনেকেই ট্রেনের কামরায় এই ‘মজলিস’ বসানোর বিরুদ্ধে। কারণ, একটা সময়ের পরে মদ্যপায়ীরা গলা চড়ান, গালিগালাজ শুরু করেন, হাতাহাতিও বাধে। কিন্তু প্রতিবাদ করতে গিয়ে কেউ দাবড়ানি খেয়েছেন, কেউ হয়েছেন অপমানিত। ফলে, এখন কামরার আসরগুলোকে এড়িয়ে ‘স্টেশন এলেই নেমে যাবো’ মানসিকতায় থাকেন তাঁরা।

টিটাগড়ে ট্রেনে বোমা ফেটে যাত্রীদের আহত ঘটনার পরে প্রাক্তন রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরী বলেছেন, ‘‘যাত্রী-সুরক্ষা বলতে কিছু নেই। দুষ্কৃতীরা কামরার মধ্যে মারপিট করছে আর তার খেসারত দিচ্ছেন যাত্রীরা।’’ হাওড়া স্টেশন থেকে ছাড়া রাতের লোকাল ট্রেনের যাত্রীদের একটা বড় অংশ বলছেন, ‘‘সুরক্ষার কথা কী বলবেন? বোমা না ফাটুক, কামরায় আসর জমানো মদ্যপদের মারপিট তো আমরা রোজ দেখি!’’

(চলবে)

train cigarette kolkata goutam bandopadhyay rail
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy