Advertisement
E-Paper

সকালে হানা মদন-ঘনিষ্ঠের বাড়িতে, ডাক জেরাতেও

সিবিআই জালে এ বার প্রভাবশালী নেতাদের ক্ষমতাশালী ঘনিষ্ঠরা। তিন রাজ্য জুড়ে সিবিআইয়ের তদন্তকারীরা এ দিন নিছক ২২ জায়গায় তল্লাশি অভিযান চালাননি। তাঁরা হানা দিয়েছেন একাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তির বাড়িতেও। সেই তালিকায় এমন কয়েক জন রয়েছেন, যাঁরা আবার ক্ষমতাশালী নেতা বা মন্ত্রীদের ঘনিষ্ঠ বলেও পরিচিত।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২৯ অগস্ট ২০১৪ ০৪:১১

সিবিআই জালে এ বার প্রভাবশালী নেতাদের ক্ষমতাশালী ঘনিষ্ঠরা।

তিন রাজ্য জুড়ে সিবিআইয়ের তদন্তকারীরা এ দিন নিছক ২২ জায়গায় তল্লাশি অভিযান চালাননি। তাঁরা হানা দিয়েছেন একাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তির বাড়িতেও। সেই তালিকায় এমন কয়েক জন রয়েছেন, যাঁরা আবার ক্ষমতাশালী নেতা বা মন্ত্রীদের ঘনিষ্ঠ বলেও পরিচিত। বৃহস্পতিবার এতগুলি জায়গায় হানা দিয়ে সিবিআই অফিসারেরা যে তথ্য পেয়েছেন, মনে করা হচ্ছে, তার ভিত্তিতে আগামী দিনে আরও বড় ‘মাথা’দের নিজেদের জালে টেনে আনতে পারেন তাঁরা।

সারদা কেলেঙ্কারিতে সিবিআই তদন্তের রায় দেওয়ার সময়েই সুপ্রিম কোর্ট সমাজের প্রভাবশালীদের জড়িত থাকার কথা বলেছিল। দু’দিন আগে সিবিআই অধিকর্তা রঞ্জিত সিন্হাও বলেছিলেন, “ধৈর্য ধরুন। যাঁরা জড়িত, একে একে সবাইকে টেনে আনা হবে আমাদের জালে।” সেটা যে ফাঁকা আওয়াজ ছিল না, তার প্রমাণ পাওয়া গেল বৃহস্পতিবার।

রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রের প্রাক্তন আপ্তসহায়ক ও ঘনিষ্ঠ সঙ্গী রেজাউল করিমের বাড়ি ছিল এ দিন সিবিআইয়ের অভিযানের তালিকায়। তৃণমূলের আর এক নেতা আসিফ খানের পার্ক সার্কাসের বাড়িতেও এ দিন তল্লাশি চালিয়ে বেশ কিছু নথি মিলেছে বলে তদন্তকারীদের দাবি। বাদ যাননি প্রাক্তন পুলিশকর্তা দেবেন বিশ্বাসও। এক সময়ের সিপিএম বিধায়ক এই পুলিশকর্তা সারদা থেকে নিয়মিত বেতন নিতেন। এ ছাড়াও, সিবিআইয়ের হাতে ধৃত ব্যবসায়ী সন্ধির অগ্রবালের অফিস এবং ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের প্রয়াত কর্তা পল্টু দাসের বাড়ি, ব্যবসায়ী সজ্জন অগ্রবালের অফিস-সহ কলকাতার মোট সাত জায়গায় হানা দেয় সিবিআই।

সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন।

অসমেও এ দিন অভিযান চালানো হয়েছে প্রভাবশালীদের বাড়িতে। সে রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা, বিধায়ক ও প্রাক্তন মন্ত্রী অঞ্জন দত্ত, প্রাক্তন পুলিশকর্তা শঙ্কর বরুয়া এবং গায়ক সদানন্দ গগৈয়ের বাড়িতে তল্লাশি হয়েছে। গুয়াহাটিতে আরও ৯ জায়গায় হানা দিয়েছেন গোয়েন্দারা। অসমের ধুবুড়িতেও দু’টি জায়গায় হানা দিয়েছেন তাঁরা। তল্লাশি চলেছে মুম্বইয়েও। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার এক শীর্ষ কর্তার ইঙ্গিত, ভবিষ্যতে এমন তল্লাশি আরও বাড়ানো হবে।

সিবিআই সূত্রের খবর, এ দিন সকাল থেকেই কেন্দ্রীয় তদন্তকারীদের সাতটি দল কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। সকাল আটটার সময় নিজেদের ব্যাঙ্ককর্মী পরিচয় দিয়ে মদন মিত্রের প্রাক্তন আপ্ত সহায়ক রেজাউল ওরফে বাপির বাড়িতে হানা দেন সিবিআই অফিসারেরা। তল্লাশি চালিয়ে বাপির বিভিন্ন ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সংক্রান্ত নথি ও আর্থিক বিনিয়োগের কাগজপত্র বাজেয়াপ্ত করা হয়। বাপিকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়। নির্দেশমতো বেলা আড়াইটে নাগাদ সল্টলেকে সিবিআই অফিসে হাজির হন বাপি। সিবিআই সূত্রের দাবি, এক সময় সারদার মিডল্যান্ড পার্কের অফিসে নিয়মিত যাতায়াত করতেন রেজাউল ওরফে বাপি। মন্ত্রীর আপ্তসহায়ক হওয়া সত্ত্বেও তিনি কেন ঘনঘন সারদার অফিসে যেতেন, তা নিয়ে টানা কয়েক ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাঁর আয়ের সঙ্গে সম্পত্তির সামঞ্জস্য রয়েছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ দিন সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ সিবিআই দফতর থেকে বেরোনোর সময় রেজাউল বলেন, “এক প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে সিবিআইয়ের হাতে আসা বেশ কিছু তথ্যপ্রমাণ আমাকে দিয়ে যাচাই করানো হয়েছে।”

সিবিআই সূত্রের খবর, উত্তর কলকাতার সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটে ইস্টবেঙ্গলের প্রয়াত কর্তা পল্টু দাসের বাড়িতে সকাল ন’টায় হানা দেন গোয়েন্দারা। জানা গিয়েছে, সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে ইস্টবেঙ্গল কর্তা দেবব্রত সরকার ওরফে নিতুর আর্থিক লেনদেনের বেশ কিছু নথি উদ্ধার হয়েছে পল্টু দাসের বাড়ি থেকে। পল্টুবাবুর স্ত্রী রীনা দাসের কিছু আর্থিকবিনিয়োগের কাগজপত্রও গোয়েন্দারা আটক করেছেন। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে। তদন্তকারীরা জানান, পল্টুবাবুর পরিবারের সঙ্গে নিতুর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। কাশ্মীরে পালানোর আগে সিবিআইকে লেখা সুদীপ্তর চিঠিতেও আমহার্স্ট স্ট্রিটের একটি বাড়ির উল্লেখ ছিল। সেখানে টাকা লেনদেন হতো বলে সুদীপ্ত তদন্তকারীদের জানিয়েছিলেন। মনে করা হচ্ছে, পল্টুবাবুর এই বাড়ির কথাই চিঠিতে উল্লেখ করেছিলেন সুদীপ্ত। বেলা দু’টো নাগাদ তল্লাশি শেষ হয়। পল্টুবাবুর পরিজনেরা জানান, রীনাদেবী অসুস্থ। কথা বলতে পারবেন না। কথা বলতে চাননি প্রাক্তন পুলিশকর্তা দেবেন বিশ্বাসও।

সারদা কেলেঙ্কারির তদন্তে নেমে গত কয়েক দিনে নিতু, সন্ধির, শান্তনু ঘোষ, প্রাক্তন পুলিশ কর্তা রজত মজুমদার-সহ সারদার সঙ্গে জড়িত কয়েক জনকে জেরা করে এবং তাঁদের বাড়িতে তল্লাশি করে কিছু সূত্র পেয়েছিলেন গোয়েন্দারা। তার ভিত্তিতেই এ দিন তল্লাশি চলে।

শান্তনু ঘোষকে এ দিনও সিবিআই দফতরে ডেকে জেরা করা হয়েছে। গত সোমবারই তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ এবং ‘কলম’ পত্রিকার শীর্ষকর্তা আহমেদ হাসান ইমরানকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে ইডি। গোয়েন্দারা বলছেন, তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতার একদা সহচর আসিফ খানের সঙ্গে এক সময় ইমরানের ঘনিষ্ঠতা ছিল। তখন তিনি ‘কলম’ পত্রিকার সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। সারদার সঙ্গেও তাঁর সম্পর্কের কথা জানতে পেরেছেন গোয়েন্দারা। পরে ইমরানের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হওয়ায় আসিফ ‘আজকের কলম’ নামে একটি আলাদা কাগজ তৈরি করেন। মাস কয়েক আগে সেই কাগজটি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। নিজেকে তৃণমূল নেতা বলেও দাবি করেন আসিফ। এ দিন অবশ্য বারবার ফোন করলেও তাঁর মোবাইল বন্ধ ছিল।

তদন্তে নেমে লাস ভেগাসে প্রবাসী বাঙালিদের একটি অনুষ্ঠান ও একটি বাংলা সিনেমার প্রিমিয়ার নিয়ে বেশ কিছু তথ্য মিলেছে বলে সিবিআই সূত্রের খবর। সেই প্রসঙ্গে সারদার পর্যটন ব্যবসা নিয়ে খোঁজখবর শুরু করে সিবিআই। বিভিন্ন লোককে জেরা করে তদন্তকারীরা জেনেছিলেন, সারদার পর্যটন সংস্থা নিজেরা টিকিটের ব্যবস্থা না করে অন্য কয়েকটি সংস্থাকে দায়িত্ব দিয়েছিল। সেই সূত্রেই এ দিন হাওড়ার রামকৃষ্ণপুর এলাকার নরসিংহ বসু লেনে একটি বহুতলে হানা দেয় চার সদস্যের সিবিআই দল। গোয়েন্দারা জানান, ওই বহুতলের তিন তলায় রাজেশ শরাফ নামে এক পর্যটন ব্যবসায়ী থাকেন। তাঁর সংস্থার সঙ্গে সারদার পর্যটন ব্যবসার যোগ ছিল বলেই তদন্তকারীদের দাবি।

অসমের প্রাক্তন মন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা ও অঞ্জন দত্তের বিরুদ্ধে টাকা নেওয়ার অভিযোগ করেছিলেন সুদীপ্ত সেন। সেই সূত্র ধরেই এ দিন হিমন্তর দু’টি বাড়ি ও তাঁর স্ত্রীর মালিকানাধীন বৈদ্যুতিন চ্যানেলে তল্লাশি চালায় সিবিআই। সম্প্রতি মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করা হিমন্ত এখন দিল্লিতে। এ দিন তাঁর বাড়িতে কেউ ছিলেন না। সিবিআই হিমন্তর বাড়ি থেকে কিছু নথিপত্র নিয়ে যায়। চ্যানেলের অফিসেও অভিযান চালিয়ে কিছু নথি ও সিডি বাজেয়াপ্ত করা হয়। হিমন্ত জানিয়েছেন, তিনি কোনও টাকা নেননি। উল্টে তিনি সুদীপ্তর বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। হিমন্তর বক্তব্য, সারদার বিস্কুট কারখানার উদ্বোধনে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সারদা যে ভুয়ো অর্থলগ্নি সংস্থা, তা তিনি জানতেন না। তিনি এক বারই সুদীপ্তর সঙ্গে দেখা করেছিলেন। সুদীপ্ত তাঁকে দু’টি সংবাদপত্র উদ্বোধনের প্রস্তাব দিলে তিনি আসার চেষ্টা করবেন বলে জানিয়েছিলেন।

প্রাক্তন মন্ত্রী অঞ্জন দত্তের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি সুদীপ্তকে সংবাদপত্রের পরিকাঠামো ও যন্ত্রপাতি বিক্রি করে বাজারদরের চেয়ে বেশি টাকা নিয়েছিলেন। পরে অঞ্জনবাবু আনন্দবাজারকে জানান, সারদার তরফে তাঁকে যে সাড়ে ৩ লক্ষ টাকার চেক দেওয়া হয়েছিল, সব বাউন্স করে। তিনি সুদীপ্ত সেনের কাছ থেকে টাকা-গাড়ি বা অন্য কিছু নেননি। তাই, সিবিআই-এর বাজেয়াপ্ত করার মতো কিছু নেই। তিনি বলেন “সিবিআই যা জানতে চেয়েছে, আমি সব বলেছি। তদন্ত হলে সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। আমি বহু দিন আগেই সুদীপ্তর বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা করেছি।”

সিবিআই এ দিন হানা দিয়েছে অসম পুলিশের প্রাক্তন ডিজি শঙ্কর বরুয়ার বাড়িতে। স্টেট ব্যাঙ্কের চেনিকুঠি শাখায় তাঁকে নিয়ে গিয়ে ব্যাঙ্কের তথ্য পরীক্ষা করা হয়। বরুয়া কোনও মন্তব্যে রাজি হননি। এ দিন তল্লাশি হয়েছে গায়ক এবং চিত্রনির্মাতা সদানন্দ গগৈয়ে সরুমটরিয়ার বাড়িতেও। অভিযোগ, সদানন্দ গগৈ গভীর রাতে হিমন্তকে নিয়ে সুদীপ্তর সঙ্গে বৈঠক করতেন। সদানন্দ অবশ্য দাবি করেছেন, তিনি শুধু সারদার বিস্কুট কোম্পানির জন্য বিজ্ঞাপন তৈরি করেছিলেন।

এ দিকে, ধুবুরিতে সারদার অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার আবদুল কাদের শেখের বাড়িতেও সিবিআই হানা দেয়। অভিযোগ, তিনি সারদার একশো কোটিরও বেশি টাকা আত্মসাৎ করেছিলেন। নামনি অসমে এজেন্টরা সারদা বলতে কাদেরকেই চিনতেন। সুদীপ্ত সিবিআইকে জানিয়েছিলেন কাদের নামনি অসম থেকে সংগ্রহ করা অর্থের ৯০ শতাংশই আত্মসাৎ করে। এই বছর মে মাসে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে।

saradha case cbi madan mitra kolkata news online news latest news kolkata online news
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy