মশাও মরল, আলোও জ্বলল! আর তার জন্য গোড়ায় কিঞ্চিৎ খরচ হলেও পরে পকেট থেকে খসল নামমাত্র!
এই জোড়া মুশকিল আসানের দিশা দিচ্ছে বিশেষ এক সৌর-বাতি। যা দিয়ে ঘুটঘুটে রাস্তা-মাঠে রোশনাই আনা যাবে। আবার তা মশা ধরার ফাঁদ হিসেবেও কাজ করবে। লাগাম পরিয়ে দেবে ডেঙ্গি-ম্যালেরিয়ার দাপটে।
মালয়েশিয়ার এক দল গবেষকের এ হেন পর্যবেক্ষণ এই মুহূর্তে বিস্তর সাড়া ফেলেছে। মশার উপদ্রব ও মশাবাহিত রোগের জ্বালায় অতিষ্ঠ কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গবাসীর কাছে এর নিঃসন্দেহে আলাদা তাৎপর্য। কিন্তু আলো জ্বালিয়ে মশা ধরা কী ভাবে সম্ভব?
মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের ব্যাখ্যা: সৌরবিদ্যুৎ ও বাতাসের জোরে চলা বাতিগুলো থেকে কম ঘনত্বের কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস ঠিকরে বেরোয়। তার গন্ধ শ্যামের বাঁশির মতো মশার ঝাঁককে কাছে টেনে আনে। তাতেই কেল্লা ফতে। আলোর নীচে বসানো জাল নিমেষে মশাদের পেটের মধ্যে টেনে নেয়। উপরন্তু এলইডি বাল্বের ওই সব বাতি বসানোর খরচ প্রথমে বেশি হলেও পরে খুব কম। দূষণ-মাত্রাও নগণ্য। গবেষকদের দাবি: কম ঘনত্বের কার্বন ডাই-অক্সাইড এত ধীরে ধীরে নির্গত হয় যে, তাতে ক্ষতিকারক গ্যাস (গ্রিন হাউস)-এর মাত্রায় তেমন হেরফের হয় না।
গ্যাসের গন্ধে বোকা বানিয়ে মশা গ্রেফতারের কসরতটি পশ্চিমবঙ্গেও প্রয়োগ করা যায় কি না, বিশেষজ্ঞেরা তা নিয়ে মাথা খাটাচ্ছেন। কম ঘনত্বের কার্বন ডাই-অক্সাইডের ‘মশক আকর্ষণী’ চরিত্রের কথা অবশ্য আগে শোনা গিয়েছে। ‘‘মানুষের নিঃশ্বাসের সঙ্গেও কম ঘনত্বের কার্বন ডাই-অক্সাইড বেরোয়। সেই গন্ধেই মশারা উড়ে এসে মানুষকে কামড়ায়।’’— বলছেন কলকাতার পতঙ্গবিদ তথা স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের প্রাক্তন অধিকর্তা অমিয় হাটি।
কুয়ালা লামপুরের মালয় বিশ্ববিদ্যালয় ইতিমধ্যে এটা পরীক্ষামূলক ভাবে চালু করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে এ ধরনের আটটি বাতিস্তম্ভ বসেছে। শহরের বিভিন্ন জায়গাতেও কয়েকটি জ্বলছে। এবং প্রাথমিক ফলাফল যথেষ্ট উৎসাহব্যঞ্জক। ‘আলোগুলো জ্বলে ওঠার কিছুক্ষণ বাদেই দেখছি, মশার ঝাঁক ছুটে আসছে।’— লিখেছেন গবেষকদলের প্রধান চং ওয়েন টং। গবেষণাপত্রে তাঁর ব্যাখ্যা, ‘আলোর অতিবেগুনি (আলট্রা ভায়োলেট) রশ্মির সঙ্গে টাইটেনিয়াম ডাই-অক্সাইডের বিক্রিয়ায় মৃদু (কম ঘনত্বের) কার্বন ডাই-অক্সাইড তৈরি হচ্ছে। তা বাতাসে মিশলে মশারা স্থির থাকতে পারছে না। মানুষের গন্ধ ভেবে সটান ফাঁদে গিয়ে সেঁধিয়ে যাচ্ছে।’
মশার স্বভাবকে কাজে লাগিয়ে কুয়ালা লামপুর যা করে দেখাল, ডেঙ্গি-ম্যালেরিয়ায় জর্জরিত কলকাতা এখনও তা পারছে না কেন?
অমিয়বাবু বলেন, ‘‘এখানেও ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা হয়েছে। তাতে এলপিজি ব্যবহার করে মশাকে কম ঘনত্বের কার্বন ডাই-অক্সাই়ডের দিকে টেনে আনা গিয়েছিল। কৌশলটা আর কাজে লাগানো হয়নি।’’ মালয়েশীয় প্রয়াসটি ফের খুঁটিয়ে দেখা উচিত বলে অমিয়বাবু মনে করছেন। অন্য দিকে ট্রপিক্যালের এন্টেমোলজি-র প্রাক্তন প্রধান হিরন্ময় মুখোপাধ্যায়ের দাবি, ২০০৬-০৭ নাগাদ এখানে এক বার চেষ্টা করেও সে রকম লাভ হয়নি।
কিন্তু এখন তো দেখা যাচ্ছে, কুয়ালা লামপুর প্রাথমিক ভাবে ফল পাচ্ছে। এমতাবস্থায় কলকাতা পুরসভা কি নতুন চেষ্টা শুরু করতে পারে না?
‘‘পারে বৈ কি! তবে একটা খটকা আছে!’’— বলছেন কলকাতা পুরসভার মুখ্য পতঙ্গবিদ দেবাশিস বিশ্বাস। ‘‘বাতিস্তম্ভগুগুলো বাইরের মশা কমাতে হয়তো সাহায্য করবে। বাড়ির ভিতরে তেমন কাজে আসবে কি?’’— সংশয় প্রকাশ করেছেন তিনি। বলছেন, ‘‘রাস্তায় এমন আলো লাগালে কিউলেক্স মশা মরবে ঠিকই। কিন্তু এখানে ম্যালেরিয়ার বাহক অ্যানোফিলিস ও ডেঙ্গুবাহী এডিস মশা মূলত বাড়ির ভিতরে আনাচে-কানাচে জন্মায়। তাদের বাগে আনতে হলে প্রযুক্তিটি বাড়ির মধ্যে ব্যবহার করতে হবে।’’ যদিও বিভিন্ন নির্মাণকাজের জায়গায়, জল জমে থাকা রাস্তা-ঘাটে, কিংবা হোটেল, হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ চত্বরে মশা নিয়ন্ত্রণে এই প্রযুক্তি কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে তিনি মনে করেন।
তার মানে কলকাতার গেরস্তবাড়িতে গজিয়ে ওঠা ডেঙ্গি-ম্যালেরিয়ার আঁতুড় নিকেশ করতে মালয়েশীয় গবেষণা কাজে আসবে না?
বিশেষজ্ঞদের একাংশ অবশ্য হাল ছাড়ছেন না। ট্রপিক্যালের এক পতঙ্গবিদ বলেন, ‘মশা কমানোর ফাঁদ-বাতি যদি সত্যিই কার্যকর হয়, তা হলে প্রযুক্তি একটু উল্টে-পাল্টে সেটি ঘরেও ব্যবহারের উপযোগী করে নেওয়া যেতে পারে।’’ তা ছাড়া বাইরের আলো দিয়ে ধানখেতের কিউলেক্স বিশনোই মশাকে কাবু করতে পারলেও অনেক লাভ হবে বলে ওঁদের অভিমত। ‘‘বিশনোই মশা এনসেফ্যালাইটিসের জীবাণু বহন করে। তাদের বংশ ধ্বংস হলে উত্তরবঙ্গ-দক্ষিণবঙ্গের বড় তল্লাটে এনসেফ্যালাইটিসের তাণ্ডব অন্তত রোখা যাবে।’’— মন্তব্য ট্রপিক্যালের আর এক পতঙ্গবিদের।
ওঁরা তাই সর্বান্তকরণে চাইছেন, মালয়েশীয় গবেষকদের উদ্যোগ যেন একশো শতাংশ সফল হয়। তা হলে কুয়ালা লামপুরের হাত ধরে কলকাতাও হয়তো এগোতে পারবে।