Advertisement
E-Paper

মিঠুনের অভিমান শুধু মমতায় নয়, রাজ্যবাসীতেও

সত্তরের দশকে ‘নকশাল’ ছেলেটা পুলিশের গুঁতো খেয়ে কলকাতা ছেড়ে পালিয়েছিল। ফিরে এসেছিল মুখ উজ্জ্বল করে। নিজের মুখ। বাংলার মুখও। কিন্তু সেই পলায়নের ৪৫ বছর পর আজ আবার তিনি বাংলা-ছাড়া। এ বার কিন্তু তাঁকে কেউ যেতে বলেনি।

গৌতম ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০১৫ ২০:০১

সত্তরের দশকে ‘নকশাল’ ছেলেটা পুলিশের গুঁতো খেয়ে কলকাতা ছেড়ে পালিয়েছিল।

ফিরে এসেছিল মুখ উজ্জ্বল করে। নিজের মুখ। বাংলার মুখও।

কিন্তু সেই পলায়নের ৪৫ বছর পর আজ আবার তিনি বাংলা-ছাড়া। এ বার কিন্তু তাঁকে কেউ যেতে বলেনি। বরং ঘনিষ্ঠরা, পরিচিতরা তাঁকে চাইছেন বাংলায়। কিন্তু, তিনি কোথাও নেই। ফোনে যোগাযোগ করা যায় না। দেখা পাওয়া যায় না। সোশ্যাল সাইটে নেই। বিলকুল বেপাত্তা। এমনকী তাঁর স্ত্রী যোগিতা, ছেলে মিমো বা পরিবারের অন্যরাও আর কলকাতার পথ মাড়াচ্ছেন না।

তিনি মিঠুন চক্রবর্তী। এক সময়ে ছিলেন জোড়াবাগানের গৌরাঙ্গ। পরে বলিউডের সুপারস্টার মিঠুন। বাংলায় তিনিই মহাগুরু। শেষমেষ তৃণমূলের টিকিটে রাজ্যসভার সাংসদ। গত লোকসভা নির্বাচনে বাংলা জুড়ে ঝড়ের মতো প্রচারাভিযান। তার পর হঠাৎ তিনি নেই। সবার নেটওয়ার্কের বাইরে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ধর্মতলা চত্বরের এক সভামঞ্চ থেকে বলেছেন, তাঁর দলের সাংসদ মিঠুন চক্রবর্তী তাঁর সঙ্গে এখন কোনও যোগাযোগই রাখেন না। এই অনুযোগ কিন্তু আরও অনেকের। দীর্ঘ দিনের পরিচিত সাংবাদিক, সহকর্মী, ঘনিষ্ঠ-সহ কলকাতার অনেকেই বহু চেষ্টাতেও আর নাগাল পাচ্ছেন না মিঠুন চক্রবর্তীর। ফোন তো করেনই না, ধরেনও না। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টরেটের (ইডি) মিঠুন-ঘনিষ্ঠ অফিসারকে ধরে বহু কসরতে মহাগুরুর সঙ্গে সামান্য যোগাযোগ সম্ভব হচ্ছে কখনও সখনও।

মিঠুন বাংলা-বিমুখ! ভাবতে কষ্ট হচ্ছে। বালাসাহেব ঠাকরে যখন মরাঠা হৃদয়পুরের একমেবামদ্বিতীয়ম অধিপতি, ‘আমচি মুম্বই’ স্লোগানে যখন মুম্বইয়ের অলিগলি সরগরম, ঠিক তখনই সৌরভকে বাদ দিয়ে কাম্বলিকে ভারতীয় দলে নেওয়ার প্রতিবাদে মুম্বইয়ে বসেই গর্জন করেছিলেন মিঠুন। হকচকিয়ে যান বালাসাহেবও। মিঠুনের সঙ্গে সুসম্পর্কের সুবাদে তাঁকে ডেকে বাল ঠাকরে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, মুম্বইতে বসে মরাঠি ক্রিকেটারের বিরুদ্ধে মুখ খোলার মতো হঠকারিতা কেন? মিঠুন সাফ জানিয়েছিলেন, মরাঠি ক্রিকেটারের বিরুদ্ধে নয়, বাঙালি ক্রিকেটারের প্রতি বঞ্চনার বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন তিনি। ফল যা-ই হোক, বাংলা বঞ্চিত হচ্ছে দেখলেই তিনি গর্জন করবেন, সোজাসাপটা বলে এসেছিলেন বাঙালির মহাগুরু। মিঠুনের এই আবেগকে সম্মান না দিয়ে পারেননি বালাসাহেবও। শিবসেনার স্বভাবসিদ্ধ উগ্রতা মিঠুনকে আর আঘাত করেনি।

শুধু এটুকুই নয়, এই মানুষটা এক সময় বাঙালি ফৌজ গড়ার স্বপ্ন দেখতেন। বাংলার মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য টাকা জোগাড় করতেন নানা উপায়ে। উন্নয়নের কাজে, মানুষের ব্যক্তিগত বিপদে মুম্বইবাসী মিঠুনকে বহু বার পাশে পেয়েছে এই বাংলা। শুধু বাঙালির পাশে দাঁড়ানোর তাগিদে ১৫-২০ কোটি টাকা বইয়ে দিয়েছেন জলের মতো। ঘনিষ্ঠরা বারণ করতেন। কখনও সে কথা কানে তোলেননি বাঙালির ‘মহাগুরু’। এখন ঘনিষ্ঠরা কাছে পেতে চাইছেন তাঁকে। কিন্তু তিনি ৩৬০ ডিগ্রি বিমুখ।

জুন মাসে মিঠুন চক্রবর্তীকে কীভাবে পেয়েছিল আনন্দবাজার? দেখে নিন এখানে ক্লিক করে:

কেন এমন?

সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে চাওয়া মানুষটার রাজনীতিতে ঢুকে পড়াটাই কি কাল হল? প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছে মিঠুন চক্রবর্তীর ঘনিষ্ঠ মহলে। কিন্তু মিঠুন চক্রবর্তীর এই আচম্বিত বাণপ্রস্থের কারণ অতটা সহজে বোঝা সত্যিই মুশকিল। একটা সময়ে রাজ্যের দাপুটে মন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তীর ঘনিষ্ঠ ছিলেন মিঠুন। সুভাষবাবুর মধ্যস্থতায় বা অনুরোধে দীর্ঘকাল নিজেকে অকাতরে বিলিয়েছেন । কিন্তু, বামফ্রন্ট সরকারের কাছ থেকে কোনও আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাননি। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভাল ছিল। কিন্তু ওই পর্যন্তই। জ্যোতিবাবুরা সরকারিভাবে কোনও স্বীকৃতি মিঠুনকে কখনও দেননি। কলকাতায় একটা বাসস্থানের দাবি ছিল মিঠুনের। বাম সরকার সেটুকুও দেয়নি। আপনার না মাইসোরে বাড়ি রয়েছে, আপনার না উটিতে হোটেল রয়েছে— কলকাতায় স্থায়ী ঠিকানা চাইলেই এমন কথা বার বার শুনতে হয়েছে মিঠুনকে। নিজেকে বঞ্চিত মনে করতে শুরু করেছিলেন মিঠুন। বাম জমানার শেষ দিকে তাই বাংলার সরকারের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ তলানিতে পৌঁছে যায়। এমনই সন্ধিক্ষণে বাংলার ক্ষমতায় তৃণমূলের অভিষেক। অনেকেই মিঠুন চক্রবর্তীকে বোঝাতে শুরু করেন, ন্যায্য পাওনা হওয়া সত্ত্বেও জীবনে যা কিছু পাননি, তার জন্য লড়বে তৃণমূল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাবমূর্তি তখন আপোসহীন সংগ্রামী হিসেবে। ভরসা খুঁজে পেয়েছিলেন মহাগুরু। আসলে সরকারি স্বীকৃতি একটা বড় ব্যাপার তাঁর জন্য। মানুষের চোখের মণি তিনি বহু যুগ ধরেই। কিন্তু, যে ছেলেটা রাষ্ট্রের গুঁতো খেয়ে নিজের শহর ছেড়ে পালিয়েছিল, জীবনে প্রতিষ্ঠার সর্বোচ্চ সীমাগুলোকে ছুঁয়ে ফেলার পর রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায় করা তাঁর কাছে আকুতির মতো। একটা ‘পদ্ম’ সম্মানও জোটেনি জীবনে। বলিউডে তাঁর চেয়ে সব অর্থেই যাঁরা অনেক জুনিয়র, তাঁরা যে সব পদক গলায় ঝুলিয়ে ঘুরছেন, মিঠুনের নাম বার বার সে সবের দোরগোড়ায় পৌঁছেও ফিরে এসেছে। এই আক্ষেপ কুরে কুরে খাচ্ছিল। ঘনিষ্ঠরা বলেছিলেন, বাঙালির অন্যতম সেরা ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডরের জন্য স্বীকৃতি আদায় করা মমতার পক্ষেই সম্ভব। এ কথা যাঁরা মিঠুনকে বুঝিয়েছিলেন, শোনা যায় কুণাল ঘোষ তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য। মমতার সঙ্গে মিঠুনের দেখাও করিয়েছিলেন কুণালই। সেই কাছে আসা শুরু। তার পর তৃণমূলের টিকিটে মিঠুনের সংসদে পৌঁছনোর ইতিহাস সকলেরই জানা।

যে উদ্দেশ্যে রাজনীতির সঙ্গে এমন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়েছিলেন মিঠুন, তা কিন্তু সাধিত হয়নি। হয়েছে ঠিক উল্টোটাই। সরকারি সম্মান না জুটুক, সারা জীবন ধরে অপার বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেছিলেন মিঠুন চক্রবর্তী। বছরের পর বছর তিনি ছিলেন বলিউডের সর্বোচ্চ করদাতা। বাংলার পাশে দাঁড়াতে অকাতরে বিলিয়েছেন জীবনভর। রাজনীতির আবর্তে সেই বিশ্বাসযোগ্যতায় আজ তুমুল ধাক্কা লেগেছে। ইডি জেরা করছে মিঠুনকে! আর্থিক কেলেঙ্কারির মামলায়! এ নিয়ে ফিসফাস চার দিকে। গুঞ্জন আনাচে কানাচে। কিন্তু, এমন এক জনকেও পাননি মিঠুন চক্রবর্তী, যিনি জোর গলায় বলবেন মিঠুন নির্দোষ। মিঠুন চক্রবর্তী আর যা-ই করুন আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়াতেই পারেন না— বাংলার কারও মুখে শোনা যায়নি এই উচ্চারণ। এ বঙ্গে বহু লব্ধপ্রতিষ্ঠ মানুষের সঙ্গে দীর্ঘ সুসম্পর্ক তাঁর। তাঁদের কেউ এগিয়ে আসেননি। কেউ মুখ ফুটে বলেননি, মিঠুন চক্রবর্তীকে নিয়ে ‘কুৎসা’ বন্ধ হোক। তীব্র অভিমানে বাংলার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন বাঙালির মহাগুরু। যে রাজ্যের জন্য এত কিছু করেছেন, সেই রাজ্য দুঃসময়ে এমন মুখ ফেরাল? তা হলে কেন আসব এই রাজ্যে? কেন যোগাযোগ রাখব এখানকার মানুষগুলোর সঙ্গে? নিজের প্রশ্নেই বিদ্ধ মিঠুন!

আইনের কুনজর এড়াতে রাজ্য ছাড়তে হয়েছিল প্রথম যৌবনে। সেই ঝড়কে জয় করেই তিনি আজ মিঠুন। কিন্তু রাজনীতি আর সারদার হাত ধরে রাষ্ট্রের সেই ভ্রূকুটি-ই আবার ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ল তাঁর জীবনে। মানতে পারছেন না মিঠুন। গুটিয়ে নিচ্ছেন নিজেকে। কারও মুখোমুখি হতে চান না। মিডিয়ার মুখদর্শন করেন না। নিজের ফিল্মের প্রমোশনে যান না। শঙ্কা! যদি অস্বস্তিকর প্রশ্নটা করে বসে কেউ? যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে— আপনি কি বেআইনি টাকার ভাগীদার?

মুম্বইতে মাড আইল্যান্ডের বাংলো থেকেও আজকাল বেরতে দেখা যায় না। ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে যান না। কলকাতায় শ্যুটিংয়ে এসে রাজারহাটের শ্যুটিং ফ্লোরেই থেকে গিয়েছেন। হোটেলে ওঠেননি। নিজের প্রিয় জায়গাগুলিতে যাননি। পরিচিতদের সঙ্গে দেখা করেননি। দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় এত রক্তাক্ত হতে বলিউডের আর কাউকে কখনও দেখা যায়নি। কিন্তু তিনি তো মিঠুন চক্রবর্তী। তাই তাঁকে ঘিরে এখন ভাঙা স্বপ্নের ছড়াছড়ি। তাঁর চার পাশে এখন বিভীষিকার সাম্রাজ্য।

Mithun Chakraborty Mamata Banerjee Distance West Bengal Diaspora
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy