ডুয়ার্স বলতে শুধু জঙ্গল বা নিসর্গ নয়। ডুয়ার্স বলতে সুপ্রাচীন এক সভ্যতারও নিদর্শন। তাই জল্পেশ বা জটিলেশ্বর মন্দিরও কেবল পুণ্যার্থীদের জন্য নয়।
জল্পেশ এবং জটিলেশ্বর দু’টিই বিখ্যাত শৈবক্ষেত্র। জল্পেশে প্রতি বছর অন্তত সাড়ে তিন লক্ষ পুণ্যার্থী আসেন। তার মধ্যে নেপাল থেকেও আসেন অনেকে। বৈশাখ, শ্রাবণ ও ফাল্গুনে বিশেষ উৎসবে মন্দিরে জনসমুদ্র তৈরি হয়। জটিলেশ্বরেও শ্রাবণ ও ফাল্গুনে বেশ ভিড় হয়। এই দু’টি মন্দিরই বেশ প্রাচীন। এর মধ্যে জল্পেশ দু’হাজারের বছরের পুরনো সিল্ক রোডের উপরেই ছিল বলে গবেষকদের অনেকের ধারণা। জটিলেশ্বরের মন্দিরটি নবম শতকের বলে মনে করেন প্রত্নতত্ত্ববিদেরা। তাই রাজ্য পর্যটন দফতর চায়, ইতিহাস সমৃদ্ধ এই এলাকাটিও সাধারণ পর্যটকদের কাছে তুলে ধরতে। পর্যটন দফতরের এক আধিকারিক জানান, যে ভাবে মালদহে পর্যটকেরা গৌড়, আদিনা মসজিদ, বারদুয়ারি দেখতে যান, সে রকম এখানেও ইতিহাসের সম্পন্ন ভাণ্ডার রয়েছে জানলে জল্পেশ, জটিলেশ্বরে আসবেন।
তাই জল্পেশ, জটিলেশ্বর ঢেলে সাজতে উদ্যোগী হয়েছে পর্যটন দফতর। ‘ডুয়ার্স মেগা ট্যুরিজম’ প্রকল্পের অধীনে মন্দিরগুলির পুরনো কাঠামো অক্ষত রেখেই কেন্দ্রীয় পর্যটনমন্ত্রকের প্রায় আড়াই কোটি টাকা আর্থিক সহযোগিতায় মন্দির চত্বর ঢেলে সাজার কাজ শেষ। পর্যটন সংস্থাগুলির আশা চলতি মরসুমেই এই দু’টি প্রাচীন মন্দিরকে ঘিরে পশ্চিম ডুয়ার্সে পর্যটন শিল্পের নতুন দিক খুলে যাবে। এমনিতেই ময়নাগুড়ি খুব সুন্দর জায়গা। এক দিকে তিস্তা আর এক দিকে জলঢাকা। পাশেই গরুমারা। ভ্রমণার্থীদের সুবিধার জন্য নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকেই বাস পরিষেবা চালুর পরিকল্পনা নিয়েছে পর্যটন দফতর।
দেখুন অ্যালবাম---পর্যটনের দুই নতুন জায়গা জল্পেশ, জটিলেশ্বরের মন্দির
মন্দির দু’টি কত প্রাচীন?
ইতিহাসবিদেরা জানাচ্ছেন, এক সময় ময়নাগুড়ি এলাকা দিয়েই গিয়েছিল প্রাচীন প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের সংযোগকারী বাণিজ্য সড়ক সিল্ক রুট। তবে তখন ময়নাগুড়ি নাম ছিল না। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষক আনন্দগোপাল ঘোষ জানান, এই এলাকাটি করতোয়া নদীর ধারে কার্জি রাজাদের অধীনে চাপগড় পরগনা বলে পরিচিত ছিল। কার্জিদের শেষ রাজা ছিলেন বজ্রধর কার্জি। সিল্ক রুটের একটি রাস্তা গিয়েছিল নেপালের দিকে। অন্যটি চিলাপাতার জঙ্গল হয়ে উত্তর-পূর্ব দিকে। সেই চাপগড় পরগনার মধ্যেই ছিল গড়তলি নামে প্রাচীন একটি জনবসতি। সেখানেই ছিল একটি পুণ্যক্ষেত্রও। যে জায়গাতেই পরে জল্পেশ মন্দির গড়ে ওঠে বলে অনুমান করা হয়। তবে প্রাচীন মন্দিরটি ভূমিকম্পে ভেঙে যায়। ১৬৩২ সালে তার উপরেই নতুন শিব মন্দির তৈরি করতে শুরু করেন কোচবিহারের রাজা প্রাণ নারায়ণ। ১৬৬৫ সালে সেই কাজ শেষ করেন তাঁর ছেলে মোদ নারায়ণ। এখন জল্পেশ উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্যতম প্রধান শৈব তীর্থ। প্রায় এক একর জমির উপরে তৈরি মন্দিরটির উচ্চতা ১২৭ ফুট। ১২৪ ফুট দীর্ঘ এবং ১২০ ফুট চওড়া। মন্দির চত্বরে রয়েছে দুই একর আয়তনের ‘সুবর্ণ কুণ্ড’ নামে জলাশয়।
গবেষকদের একাংশের দাবি, ময়নাগুড়ি শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে জটিলেশ্বর মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ পাল যুগের। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের দীপক রায় বলেন, “প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানে সমৃদ্ধ দুটি মন্দিরে দেশ-বিদেশের প্রচুর মানুষ আসেন। ভাঙাচোরা পরিবেশ দেখে এত দিন তাঁদের হতাশ হয়ে ফিরে যেতে হয়েছে। এখন ভিড় বাড়বে।” শুধু মন্দিরের বাইরের এলাকা নয়। গর্ভ গৃহে পর্যাপ্ত আলো এবং পাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। জলাশয় রেলিং দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে। জলাশয়ের পাড় বাধিয়ে পর্যটকদের বসার জায়গা করা হয়েছে। গড়ে তোলা হচ্ছে ২৭ টি শৌচাগার।
জটিলেশ্বর মন্দিরটি পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের অধিগৃহীত। তারাই মন্দিরটির দেখভাল করেন। জল্পেশের মন্দিরটি সাজানোর সময় অবশ্য প্রধান কাঠামোর উপরে হাত দেওয়া হয়নি। মাথা তুলেছে বিরাট তোরণ। তৈরি হয়েছে সবুজ ঘাসের গালিচা, উদ্যান, প্রতীক্ষালয়, পার্কিং জোন, জলাশয়ের পাড়ে বসে নিরিবিলি সময় কাটানোর ব্যবস্থা। রঙিন সিমেন্ট ব্লক এবং আলোকসজ্জায় মুড়ে ফেলা হয়েছে গোটা চত্বর। রাজ্য পর্যটন দফতরের যুগ্ম অধিকর্তা সুনীল অগ্রবাল জানান, “এত দিন ডুয়ার্স বলতে ধারণা ছিল জঙ্গল, চা বাগান। আমরা সেটা ভাঙতে চাইছি। এখানে দেখার মতো অনেক ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে। সেগুলি পর্যটকদের সামনে তুলে ধরে ডুয়ার্স মেগা ট্যুরিজম প্রকল্পের অধীনে দুটি মন্দিরকে আকর্ষণীয় করা হয়েছে। আশা করছি দ্রুত পর্যটনের নতুন সার্কিট তৈরি করা সম্ভব হবে।” তিনি জানান, ওই কাজে খরচ হয়েছে ২ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা। জল্পেশ মন্দির কমিটির সম্পাদক গিরীন্দ্রনাথ দেব জানান, মন্দিরটিও অবিলম্বে সংস্কারের দরকার রয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘সে জন্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ চাওয়া হয়েছে।’’
পশ্চিম ডুয়ার্সের পর্যটন শিল্পে বৈচিত্র আনতে ময়নাগুড়ির বটেশ্বর, ভদ্রেশ্বর, পেটকাটি মন্দির চত্বরকেও ঢেলে সাজার দাবি দীর্ঘদিনের। ট্যুর অপারেটার সংস্থা ‘হেল্প ট্যুরিজমের’ তরফে রাজ বসু বলেন, “লাটাগুড়ির পরে পশ্চিম ডুয়ার্সকে দেখা যায় না। এখানে পর্যটন জঙ্গল কেন্দ্রিক। জল্পেশ, জটিলেশ্বর মন্দিরকে আকর্ষণীয় করে তোলায় নতুন সার্কিট গড়ে ওঠার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হল। আমরা কয়েকশো বছরের প্রাচীন বটেশ্বর, ভদ্রেশ্বর, পেটকাটি মন্দির চত্বরকে সাজানোর আবেদন জানাব।”
গিরীন্দ্রনাথবাবু বলেন, “উত্তর পূর্বাঞ্চলের ইতিহাসের অনেক কথা এখানে লুকিয়ে আছে। বেড়াতে এসে পর্যটকরা সে সব কথাও জানার সুযোগ পাবেন।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy