Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

ঐতিহ্যের টানে আজও দোলে ঝুলনের দোলনা

শুধু কলকাতাই নয়, মফস্সলের বিভিন্ন জায়গায় ঝুলন উৎসব অমলিন। লিখছেন বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্যশুধু কলকাতাই নয়, মফস্সলের বিভিন্ন জায়গায় ঝুলন উৎসব অমলিন। লিখছেন বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য

রামকানাই অধিকারী বাড়ির ঝুলন। নিজস্ব চিত্র।

রামকানাই অধিকারী বাড়ির ঝুলন। নিজস্ব চিত্র।

শেষ আপডেট: ০৩ অগস্ট ২০১৭ ২১:৫৮
Share: Save:

মথুরা-বৃন্দাবনের মতোই বাংলার ঝুলন উৎসবের ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। শুধুমাত্র রাধাকৃষ্ণের যুগলবিগ্রহ দোলনায় স্থাপন করে হরেক আচার অনুষ্ঠান উৎসব নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক তাৎপর্য। শ্রাবণের শুক্লা একাদশী থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত চলে এই উৎসব। এই উৎসব হয় মূলত বনেদিবাড়ি এবং মঠ-মন্দিরে। তবে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের পাশাপাশি ছোটদের ঝুলন সাজানোর আকর্ষণ হারিয়ে যায়নি। আজও অমলিন নানা ধরনের মাটির পুতুল, কাঠের দোলনা আর গাছপালা দিয়ে ঝুলন সাজানোর আকর্ষণ।

কলকাতার ঝুলন প্রসঙ্গে ‘ঝুলনবাড়ি’-র কথা বিশেষ উল্লেখ্য। এই নামেই পরিচিত বউবাজারের রামকানাই অধিকারীর বাড়ি। প্রায় ২০০ বছর আগে এই পরিবারের আদিপুরুষ কৃষ্ণমোহন অধিকারী ঝুলন উৎসবের প্রচলন করেন। পরে তাঁর পৌত্র রামকানাই অধিকারী সাড়ম্বরে এই উৎসবের প্রচলন করেছিলেন। এই বাড়ির রাধাবল্লভ জিউর ঝুলন উৎসব আজও বহু মানুষকে আকৃষ্ট করে। এ বাড়িতে এই ঝুলন উৎসব হয় পাঁচ দিন ধরে। আর তাই এই পাঁচ দিনে দেবতাকে বিভিন্ন বেশে সাজানো হয়। প্রথম দিন রাখাল বেশ, দ্বিতীয় দিন যোগী বেশ, তৃতীয় দিনে সুবল বেশ, চতুর্থ দিনে হয় কোটাল বেশ এবং শেষ দিনে রাজ বেশ। প্রথম দিনে হোম করে ঝুলন উৎসবের সূচনা করা হয়। এর পরে দেবতাকে এক এক দিন এক এক রকমের ভোগ নিবেদন করা হয়। পুরনো ঐতিহ্য বজায় রেখে আজও পাঁচ দিনের এই উৎসবে আত্মীয় সমাগম হয়।

আরও পড়ুন: মন ছুঁয়ে গিয়েছে মোদীর শেষ চিঠি, ১০ দিন পেরিয়ে আপ্লুত টুইট প্রণবের

এই পরিবারে ঝুলন উৎসবের আরও এক আকর্ষণ ধ্রুপদী সঙ্গীতের আসর। রামকানাই নিজে ভাল পাখোয়াজ বাজাতেন, এমনকী, তিনি যদুভট্টের সঙ্গে সঙ্গত করতেন। যদুভট্ট ছাড়াও আসরে এক কালে আসতেন অঘোরনাথ চক্রবর্তী, রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামী প্রমুখ শিল্পী। পরবর্তী কালে আসতেন জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, ভিজি যোগ, মালবিকা কানন, এটি কানন, হীরু গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ শিল্পী। অতীতের মতো আজও বসে সঙ্গীতের আসর। এখনও বিভিন্ন শিল্পী এখানে সঙ্গীত পরিবেশন করেন। আর রসিক শ্রোতারা সেই আকর্ষণে ভিড় করেন উৎসবের দিনগুলিতে।

বিনোদ সাহা লেনের মন্ডল বাড়িতে ঝুলনযাত্রা উপলক্ষে বিশেষ পুজো হয়ে থাকে।

চালতাবাগান অঞ্চলে বিনোদ সাহা লেনে বঙ্কুবিহারী সাহা প্রতিষ্ঠিত রাধাকৃষ্ণের ঝুলন মন্দিরে ঝুলনযাত্রা উপলক্ষে বিশেষ পুজো হয়ে থাকে। এই উপলক্ষে বিশেষ ভোগ নিবেদন করা হয়। মন্দির চত্বরে ছোট ছোট ঘরগুলির মধ্যে কৃষ্ণলীলা ও মহাভারতের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলি মাটির পুতুল দিয়ে সাজানো হয়। ওই একই রাস্তায় মণ্ডল পরিবারের রাধাকৃষ্ণ জিউর মন্দিরে ঝুলন হয়। একাদশী থেকে দ্বিতীয়া পর্যন্ত মোট সাত দিন ধরে চলে এই ঝুলন উৎসব।

আরও পড়ুন: ভিন্‌ ধর্মের মহিলার সঙ্গে প্রেম, নগ্ন করে মার যুবককে

প্রথম দিন রাধাকৃষ্ণের যুগল বেশ, দ্বিতীয় দিনে অনন্ত দর্শন, তৃতীয় দিনে রাসলীলা, চতুর্থ দিনে নৌকাবিলাস, পঞ্চম দিনে চন্দ্রাবলীকুঞ্জ, ষষ্ঠ দিনে রাইরাজা এবং সপ্তম দিনে মিলন বেশ। ঝুলন উপলক্ষে প্রতি দিন নিবেদন করা হয় লুচি, মালপোয়া, সুজি ইত্যাদি। ঝুলন উপলক্ষে ওই এলাকার আর এক আকর্ষণ জমজমাট মেলা। মেলা বসে বিনোদ সাহা লেনে এবং বিবেকানন্দ রোডের ফুটপাথের কিছুটা অংশ জুড়ে।

খড়দহের শ্যামসুন্দর মন্দির।

তেমনই দক্ষিণ কলকাতার টালিগঞ্জ রোডে বাওয়ালির মণ্ডল পরিবারের উদয়নারায়ণ মণ্ডল প্রতিষ্ঠিত মদনমোহন জিউর মন্দিরে, যা বড় রাসবাড়ি বলে পরিচিত, আজও পালিত হয় ঝুলন উৎসব। এখানে ঝুলন হয় তিন দিনব্যাপী। এই সময় প্রতি দিন ভোরে দেবতাকে ডাবের জল দিয়ে স্নান করানো হয় এবং প্রতি দিন নতুন ভাবে সাজানো হয়।

বিনোদ সাহা লেনের মন্ডল বাড়ির ঝুলন উৎসব।

ঝুলন উপলক্ষে হয় নামসংকীর্তন। এই সময় প্রতি দিন ২৫-৩০ রকমের ফলের নৈবেদ্য, লুচি, সুজি নিবেদন করা হয়। অন্য দিকে, কুমোরটুলি অঞ্চলে গোকুলচন্দ্র মিত্র প্রতিষ্ঠিত রাধামদনমোহন জিউর মন্দিরে সাড়ম্বরে পালিত হয় ঝুলন উৎসব। এই উপলক্ষে আজও বহু ভক্ত সমাগম হয়।

আরও পড়ুন: সন্দেশখালি গেলেন লকেট, ফিরতে হল বিক্ষোভের মুখে

তবে শুধু কলকাতাতেই নয়, মফসসলের বিভিন্ন মন্দিরেও চলে ঝুলন উৎসব। তার মধ্যে খড়দহের শ্যামসুন্দরের ঝুলন উৎসব এবং ইছাপুরের নবাবগঞ্জের ঝুলনের মেলায় আজও দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসেন। তেমনই নদিয়ার শান্তিপুরের বড়গোস্বামী বাড়িতে কয়েক’শো বছর ধরে সাড়ম্বরে হয়ে আসছে রাধারমন জিউর ঝুলনযাত্রা। উৎসব চলে তিন দিন ধরে। দেবতাকে পরানো হয় এক এক ধরনের বেশ। মূল পুজোটি হয় পূর্ণিমার দিনে। সে দিন উদয়াস্ত ভাগবত পাঠ হয়। এই উপলক্ষে অসংখ্য ভক্ত সমাগম হয়। ঝুলন উপলক্ষে হয় বিশেষ অন্নভোগ। বড়গোস্বামী ছাড়াও শ্যামচাঁদ মন্দির, গোকুলচাঁদ মন্দিরে এবং অন্যান্য বিগ্রহবাড়িতে এই উৎসব হয়ে থাকে। কিছু কিছু জায়গায় হয় পুতুল ঝুলন। এখানে নানা ধরনের পুতুল দিয়ে সাজানো হয়।

বিনোদ সাহা লেনের সাহাবাড়ির ঝুলন।

তবে নবদ্বীপের ঝুলনের আলাদা আকর্ষণ বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী মানুষের কাছে। এক দিকে যেমন কিছু পাড়ায় দেখা যায় সর্বজনীন ঝুলন উৎসব, অন্য দিকে পুরনো মঠে কিংবা মন্দিরে ঐতিহ্যশালী ঝুলন উৎসব। বেশ কিছু সর্বজনীন রাস উৎসবে দেখা যায় থিমের প্রাধান্য। তবে নবদ্বীপের পুরনো মঠে-মন্দিরে আজও মেলে সাবেক ঝুলনের আমেজটা। যেমন মহাপ্রভু মন্দিরে রাধাকৃষ্ণের ঝুলন নয়, হয় শ্রীচৈতন্যের ঝুলন উৎসব। উৎসব চলে এক পক্ষ কাল, প্রতিপদ থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত। তেমনই সমাজবাড়িতে বৃন্দাবনের গোস্বামী মতে তেরো দিন ধরে ঝুলন হয়। এ ছাড়াও মোহন্তবাড়ি, রাধা মদনমোহন মন্দির, গোবিন্দবাড়ি, গোরাচাঁদের আখড়া, বলদেববাড়ি ইত্যাদি মঠ-মন্দিরে উৎসবের ভিন্ন ভিন্ন মেজাজ দেখা যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE