Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

ক্লাব টাকা পায়, অ্যাসিড-আক্রান্তেরা?

রাজ্যের বিভিন্ন ক্লাবের উন্নয়নে সরকার টাকা বরাদ্দ করছে, ভাল কথা। কিন্তু অ্যাসিড-আক্রান্তদের চিকিৎসার পুরো খরচ মেটানো এবং তাঁদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে কি না, সেই প্রশ্ন তুললেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০৩:২৮
Share: Save:

রাজ্যের বিভিন্ন ক্লাবের উন্নয়নে সরকার টাকা বরাদ্দ করছে, ভাল কথা। কিন্তু অ্যাসিড-আক্রান্তদের চিকিৎসার পুরো খরচ মেটানো এবং তাঁদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে কি না, সেই প্রশ্ন তুললেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত।

অ্যাসিড-আক্রান্তদের জন্য রাজ্য সরকারের পরিকল্পনা কী, সেটাই জানতে চায় হাইকোর্ট। তাঁদের জন্য সরকার এ-পর্যন্ত কী ব্যবস্থা নিয়েছে, ২ মার্চের মধ্যে সেই বিষয়ে একটি রিপোর্ট দিতে হবে বলে শুক্রবার নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি দত্ত।

সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ, কেউ অ্যাসিড-হামলার শিকার হলেই প্রাথমিক ভাবে তিন লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। যেখানে হাসপাতালে আক্রান্তের প্রাথমিক চিকিৎসা হবে, সেই হাসপাতালের দেওয়া শংসাপত্রের ভিত্তিতেই পরবর্তী কালে রাজ্য বা কেন্দ্রের অধীন যে-কোনও হাসপাতালে বিনা খরচে প্লাস্টিক সার্জারি বা অন্য চিকিৎসার সুযোগ দিতে হবে তাঁকে।

কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই অ্যাসিড-দগ্ধ তরুণী-কিশোরীরা সেই সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন না। যথাসময়ে ক্ষতিপূরণ মিলছে না, বিনা খরচে চিকিৎসা হচ্ছে না, প্রতিবন্ধকতার শংসাপত্র এবং পুনর্বাসনের সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে না ইত্যাদি অভিযোগ নিয়ে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন এমনই সাত অ্যাসিড-আক্রান্ত তরুণী। তাঁদের অধিকাংশের বক্তব্য, রাজ্যের কাছ থেকে তাঁরা

নিয়মিত চিকিৎসার টাকা পাচ্ছেন না। কিছু ক্ষেত্রে এখনও ক্ষতিপূরণ মেলেনি। সেই সব মামলার শুনানিতেই বিচারপতি দত্ত এ দিন রাজ্যের আইনজীবী তপন মুখোপাধ্যায়ের কাছে জানতে চান, অ্যাসিড-আক্রান্তদের জন্য সরকারের পরিকল্পনাটা কী? তপনবাবু জানান, অ্যাসিড-আক্রান্তদের জন্য রাজ্য ৫০ লক্ষ টাকার তহবিল গড়েছে। সেই তহবিলের নিয়ন্ত্রক ‘রাজ্য লিগাল এড সার্ভিস’-এর সদস্য-সচিব। ওই সংস্থার মাধ্যমেই আক্রান্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া এবং চিকিৎসার খরচ জোগানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।

কিন্তু অ্যাসিড-আক্রান্ত অনেক তরুণী-কিশোরী যথাসময়ে চিকিৎসা বা ক্ষতিপূরণ কেন পাচ্ছেন না, সেই প্রশ্নের জবাব এ দিন মেলেনি। জয়নগরের বাসিন্দা, অ্যাসিড-আক্রান্ত মণীশা পৈলানের আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় ও শীর্ষেন্দু সিংহরায় আদালতে অভিযোগ করেন, তাঁদের মক্কেল চিকিৎসার পুরো খরচ পাননি। যে-যুবক তাঁর মুখে অ্যাসিড ছুড়েছিল, পুলিশ তাকে গ্রেফতারও করেনি। দমদমের অ্যাসিড-আক্রান্ত তরুণী সঞ্চয়িতা যাদবের আইনজীবী পৃথা ভৌমিকের অভিযোগ, তদন্ত তো দূরের কথা, পুলিশ তাঁর মক্কেলের বক্তব্য নথিভুক্তই করেনি। অ্যাসিড-আক্রান্ত তরুণী ঝুমা সাঁতরার আইনজীবীর দাবি, তাঁর মক্কেল ১০০ শতাংশ প্রতিবন্ধী। কিন্তু এখনও প্রতিবন্ধকতার শংসাপত্র পাননি।

সমাজকর্মীদের একাংশের অভিযোগ, বেশ কিছু ক্ষেত্রে সরকার সক্রিয় ভূমিকা না-নেওয়ায় অ্যাসিড-আক্রান্তদের দিন কাটছে অসহায় অবস্থায়। যেমন মুর্শিদাবাদের অঙ্গুরা বিবি। চার বছরের মেয়ে নিয়ে এখন অকূলপাথারে পড়েছেন তিনি। স্বামীর সঙ্গে অন্য এক যুবতীর সম্পর্কে মদত দিচ্ছে শ্বশুরবাড়ির লোকজন, এই ছিল অঙ্গুরার অভিযোগ। এবং তার জেরেই স্বামীর সঙ্গে সম্পর্কে চিড় ধরে। এক দিন বাদানুবাদের জেরে স্ত্রীর মুখে স্বামী অ্যাসিড ঢেলে দেন বলে অভিযোগ। একেই শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছিল। তার উপরে স্বামীর পরিবার পোড়া মুখের বৌয়ের

চিকিৎসা করাতে অস্বীকার করায় কোলের মেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যান অঙ্গুরা। কিন্তু সেখানেও দুর্ভাগ্য তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় তাঁকে। বাপের বাড়ির লোকজন ধারদেনা করে ছ’লক্ষ টাকা জোগাড় করে অঙ্গুরার চিকিৎসা করান। সেই ঋণ শোধের রাস্তা নেই দেখে এক দিন গ্রাম ছেড়ে চলে যান তাঁরা। আর অঙ্গুরা দ্বারস্থ হন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার। সেই সংস্থার উদ্যোগেই উচ্চ আদালতে পৌঁছেছেন ওই গৃহবধূ।

অ্যাসিড-ক্ষতের চিকিৎসা নিয়ে আতান্তরে মণিকা মণ্ডলও। স্বামীর তেমন রোজগার নেই, তাই স্ত্রীর নিত্যদিনের চিকিৎসা চালাতে পারছেন না। আদালত সূত্রের খবর, সাধের দিন গয়না চুরির অভিযেগে এক প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন মণিকা। আচমকাই গর্ভের সন্তান নষ্ট হয়ে যাওয়ায় মনমরা হয়ে বাপের বাড়িতেই ছিলেন মণিকা। এক দিন বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। তখনই প্রতিবেশীর ছোড়া অ্যাসিডে পুড়ে যান ওই তরুণী।

অ্যাসিড-আক্রান্তদের দুর্দশার বারোমাস্যা শুনে বিচারপতি দত্তের প্রশ্ন, মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ হিসেবে তো চাকরি মেলে। অ্যাসিড-আক্রান্তদের জন্য কি তেমন কোনও প্রকল্প নেওয়া যায় না? সেই বিষয়েই রিপোর্ট পেশের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সরকারকে। সমাজকর্মীরা জানাচ্ছেন, অ্যাসিড-আক্রান্তের ঘটনা বাড়ছে। ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দিচ্ছে হাইকোর্ট। কিন্তু রাজ্য সরকার এই বিষয়ে কড়া পদক্ষেপ করছে না। তাদের দাবি, পরিচয়পত্র ছাড়া যাতে অ্যাসিড বিক্রি

করা না-হয়, সেই ব্যাপারে পুলিশকে আরও সক্রিয় হোক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

High Court Judge Acid Attack Victim Club
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE