বেশির ভাগ মৃতদেহই আপাত ভাবে ক্ষতচিহ্নহীন। বড়জোর নাকের কাছে একটু কার্বনের কালো দাগ। চিরঘুমে শুয়ে থাকা ফুটফুটে শিশুকেও মৃত বলে মনেই হচ্ছে না। বড়বাজারের হোটেলে মৃতদের দেখে অনেকের চোখে ভেসে উঠেছে আমরি হাসপাতালে মৃতদের ছবি। গাফিলতি ও দায়িত্বজ্ঞানহীনতার বিষবাষ্পে ১৪টি প্রাণ কেড়ে নেওয়ার আবহে ছায়া ফেলছে দেড় দশকের পুরনো ক্ষত।
২০১১-র ৮ ডিসেম্বর গভীর রাতে আমরি হাসপাতালের আগুনের ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে ৯৩ জনের মৃত্যু হয়েছিল। সেই রাতে হাসপাতালেই ছিলেন ১৪ বছরের হতভাগ্য এক কিশোরী রোগিণীর বাবা ধনঞ্জয় পাল। তিনি বলছিলেন, ‘‘আগুনের ঘটনায় ন্যায়বিচার যে কিসে মেলে! ১৪ বছর হতে চলল। আমরির মালিকানাও পাল্টে গেল। আমি আজ পর্যন্ত সাক্ষ্য দিতেই ডাক পেলাম না!’’ একই ভাবে ২০১০ সালের ২৩ মার্চ পার্ক স্ট্রিটে জ্বলন্ত স্টিফেন কোর্ট বহুতলটি থেকে বিপন্ন অফিসকর্মী, আবাসিকদের ঝাঁপিয়ে পড়ার বিভীষিকাও অনেকের মনে পড়ছে। স্টিফেন কোর্টে ৪৩ জন আগুনের বলি হয়েছিলেন। বহুতলটির লিজ়ধারী সংস্থার তৎকালীন কর্তা সঞ্জয় বাগাড়িয়া গ্রেফতারও হন। কিন্তু সেই মামলাও বিশ বাঁও জলে।
বড়বাজারের হোটেলের অগ্নিকাণ্ড কলকাতার সাম্প্রতিক ইতিহাসের দু’টি আগুনে কার্যত গণহত্যার দগদগে স্মৃতিও খুঁচিয়ে তুলেছে। রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের ফার্মাসিস্ট ধনঞ্জয় বলছিলেন, ‘‘হাসপাতালের বেসমেন্টে আগুন লাগার পরে হাসপাতালের কর্মীরা মিলে আগুন নেভানোর চেষ্টা করছেন, আমরা ক’জন আমাদের আত্মীয় রোগীদের বার করে আনতে অনুরোধ করছি, নিরাপত্তারক্ষীরা আমাদের ঢুকতেই দিচ্ছেন না— সব ছবির মতো মনে পড়ে। দমকল পরে এলেও কিচ্ছু করা যায়নি। মেয়েকে দেখে মনে হচ্ছিল, ঘুমোচ্ছে। শুধু নাকের কাছে কার্বনের কালো দাগ।’’ কন্যাহারা ওই বাবা জানাচ্ছেন, বছর চারেক আগেই তাঁকে সাক্ষ্যের জন্য তৈরি থাকতে বলা হয়েছিল। সেই ডাক এখনও আসেনি।
সরকারি কৌঁসুলি শক্তি ভট্টাচার্যের ব্যাখ্যা, মাঝে বছর চারেক ধরে আদালতে ৯৩ জন মৃতের ময়না তদন্ত রিপোর্ট পড়া হয়েছে। প্রবীণ ডাক্তার বিশ্বনাথ কাহালি এক-এক বারে দু’-এক জনের বেশি রিপোর্ট পড়তেই কাহিল হয়ে পড়তেন। তিনি গত বছর মারা গিয়েছেন। এখন ওই চিকিৎসকের হাতের লেখা যাঁরা চেনেন, তাঁদের বয়ান নেওয়া হচ্ছে। শক্তির আশা, ‘‘এ বার মামলা নিশ্চয়ই গতি পাবে।’’ তবু মাসে একটি বা দু’টি শুনানি পড়ছে। তাই হতাশ সংশ্লিষ্ট অনেকে।
স্টিফেন কোর্টের অগ্নিকাণ্ডের পরে নিজেদের একটি সমিতি গড়ে তুলেছেন আবাসিকেরা। সেই সমিতির কর্তা দেবাশিস গুহ নিয়োগী বলছেন, ‘‘এত দিন বাদে মনে হয়, কোনও এক জনকে এই ঘটনার জন্য দায়ী করা যায় না। লিজ়ধারী মালিক বা কেয়ারটেকারকে দায়ী করলে আমরা যারা অত বিপদের মধ্যে কোনও সতর্কতা ছাড়া ওই বহুতলে থাকছিলাম বা অফিস চালাচ্ছিলাম, তাদেরও দায় থাকে। সরকারি নজরদারির অভাব তো ছিলই। এখনও আছে।’’ এখন স্টিফেন কোর্টের বাসিন্দারা ছ’কোটি টাকা খরচ করে বহুতলটি সারিয়েছেন। আমরির ঘটনায় হতভাগ্য ধনঞ্জয় এ দিন বলেন, ‘‘এত ভয়ঙ্কর সব ঘটনা ঘটে কলকাতায়। এত মৃত্যু হয়। তবু প্রশাসন কিছুই শেখে না। তাই ফের একই ঘটনা ঘটে চলে।’’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)