ঊষারানি রায়ের বয়স এখন ৩৪ বছর। বাপের বাড়ি ছিল বাংলাদেশের ডোমার থানার ডুগডুগি বড়গাছা গ্রামে। কুড়ি বছর আগে ছিটমহলের দহলা খাগড়াবাড়িতে ব্রজ রায়ের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল ঊষারানির।
যখন ছোট ছিলেন, দেখতেন বাপের বাড়ির সবাই ভোট দিতে যেত। তাঁদের হাত ধরে ভোটকেন্দ্রে যেতেন ঊষারানিও। বিয়ের পর দহলা খাগড়াবাড়ি গ্রামে এসে দেখেন সেখানে কেউ ভোট দিতে যায় না। শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার পরে ভোট দেওয়ার বয়স হয়েছিল তাঁর। কিন্তু প্রশ্ন করে জেনেছিলেন, এরা কেউ ভোট দেয়না। কেনর উত্তর অবশ্য পাননি। পরে আস্তে আস্তে তিনি জানতে পারেন দহলা খাগড়াবাড়ি গ্রামটি ভারতের ছিটমহল। তাই গ্রামের কারোই ভোটাধিকার নেই।
ঊষারানি বলেন, “এখন নিজের দেশে আসার পর এটাই আমার সেরা আনন্দ যে এখন আমি ভোট দিতে পারব। ছোটবেলার কথা মনে পড়ছে। তখন আমরা বড়দের হাত ধরে ভোটকেন্দ্রে যেতাম। এখন আমাদের হাত ধরে ছোটরা যাবে।”
শুধু ঊষারানিই নন, ভোট দিতে পারার আনন্দে মেতেছেন হলদিবাড়ির ক্যাম্পে থাকা সাবেক ছিটমহলবাসীদের সকলেই। মঙ্গলবার জেলা নির্বাচন দফতরের উদ্যোগে হলদিবাড়ির ক্যাম্পে বসবাসকারী সমস্ত বাসিন্দাদের ভোটার কার্ড তৈরির প্রক্রিয়া একদিনেই শেষ করা হয়। নির্বাচন দফতরের কর্মীরা প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে তাদের সচিত্র পরিচয়পত্র বানানোর কাজ করেন। ছবিও তোলা হয়। ব্লক নির্বাচন দফতর সুত্রে জানা যায়, হলদিবাড়ির ক্যাম্পে মোট ভোটারের সংখ্যা ২৮৬ জন।
বাসিন্দাদের পক্ষ থেকে অভিযোগ উঠেছে বাংলাদেশে নাম তোলার সময় অনেকের নাম এবং বয়স ভুল আছে। তাদের সংশোধনের কোন সুযোগ না দিয়ে নাম তোলা হয়েছে। জেলা নির্বাচন দফতর সুত্রে জানা যায় যে সাবেক ছিটমহলের বাসিন্দাদের ভারতে আসবার সময় বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে একটা করে ট্র্যাভেল পাশ দেওয়া হয়েছিল। সেই ট্র্যাভেল পাশে যে নাম এবং বয়স উল্লেখ আছে তাকে ভিত্তি করেই ভোটার কার্ড তৈরি হচ্ছে। কোনও সংশোধন করা হচ্ছে না।
বাসিন্দাদের অভিযোগ বাংলাদেশ থেকে হয়ে আসা ভুল এখানে আসার পর কেন সংশোধন করা হবে না? এখানকার বাসিন্দা পরেশ রায়ের অভিযোগ তার বয়স ৪০ বছর। অথচ ট্র্যাভেল পাশে লেখা হয়েছে ৫৪ বছর। তার বয়সের প্রমাণপত্র থাকা সত্ত্বেও ভুল বয়স দেওয়া হয়েছে। মেখলিগঞ্জ মহকুমার নির্বাচন আধিকারিক অপ্রতিম ঘোষ বলেন, “ভারত সরকারের বিদেশ মন্ত্রক থেকে দেওয়া তথ্যপঞ্জীতে যে নাম এবং বয়স দেওয়া হয়েছে, সেই নামই ভোটার কার্ডে থাকবে। কোনওরকম পরিবর্তন করা হবে না।” কারণ দু’টি দেশের বিদেশ মন্ত্রকের নামের তালিকা অনুযায়ী তারা এদেশে এসেছেন।
সমস্যা যাই থাক না কেন আপাতত যে নাম আছে সেই নাম নিয়েই তাদের ভোটার কার্ড তৈরি হয়েছে। ভোটার কার্ড তৈরি হচ্ছে তাই তাঁরা ভোট দিতে পারবেন। এই আনন্দেই মেতেছেন সবাই। এতদিন ভোটের সময় তাতে সামিল হওয়ার কথা ভাবতে পারেননি। একদা নাজিরগঞ্জ ছিটমহলের বাসিন্দা উপেন্দ্রনাথ রায়, হাসিরানি রায়, পোহাতু বর্মন বলেন, “এতদিন ভোট হত আর আমরা তাকিয়ে দেখতাম। কখনও ভোট দিতে পারব ভাবিনি। আজ আমাদের পরিচয়পত্র তোলার কাজ সম্পূর্ণ হল। এখন আমরা ভোট দিতে পারবো। আমাদের দীর্ঘদিনের আশা পূর্ণ হতে চলেছে।”
বাংলাদেশের মধ্যে ছিটমহলে থাকার সময় এরা ভোট দিতে পারতেন না ঠিকই। কিন্তু বাংলাদেশে ওদের হাটবাজার করতে হত। বন্ধু বান্ধবরাও ছিলেন। ভোট আসলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে ওদের মিছিলে যাওয়ার জন্য ডাক আসতো। ওরা মিছিলে যেতেন। একদা দহলা খগড়াবাড়ির বাসিন্দা দ্বিজেন রায়, পেটভাজনি গ্রামের বাসিন্দা গীতিশ রায় বলেন, “কেবল মিছিলে যাওয়ার জন্য আমাদের ডাক পড়তো। আমরা মিছিলে যেতাম। ভোটের কেবল এইটুকু স্বাদই আমরা পেতাম।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy