Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

খাগড়াগড়ের সঙ্গে মিল রয়েছে মেটিয়াবুরুজের

মেটিয়াবুরুজে মোটামুটি ধামাচাপা পড়েছিল। খাগড়াগড়ে পড়ল না। ২ অক্টোবর বর্ধমানের এই এলাকায় আইইডি (ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) বিস্ফোরণের পরে, এ রাজ্যে সে ধরনের নাশকতায় জেহাদি জঙ্গিদের জড়িত থাকার ইঙ্গিত স্পষ্ট কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের কাছে। গাঁধীজয়ন্তী তথা দুর্গাষ্টমীর দুপুরে বর্ধমান শহরের অদূরে খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণে জেহাদি জঙ্গিরা জড়িত এবং পশ্চিমবঙ্গে এমন বিস্ফোরণ ও তাতে প্রাণহানির এটি দ্বিতীয় ঘটনা বলে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের দাবি।

সুরবেক বিশ্বাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:২২
Share: Save:

মেটিয়াবুরুজে মোটামুটি ধামাচাপা পড়েছিল। খাগড়াগড়ে পড়ল না। ২ অক্টোবর বর্ধমানের এই এলাকায় আইইডি (ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) বিস্ফোরণের পরে, এ রাজ্যে সে ধরনের নাশকতায় জেহাদি জঙ্গিদের জড়িত থাকার ইঙ্গিত স্পষ্ট কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের কাছে।

গাঁধীজয়ন্তী তথা দুর্গাষ্টমীর দুপুরে বর্ধমান শহরের অদূরে খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণে জেহাদি জঙ্গিরা জড়িত এবং পশ্চিমবঙ্গে এমন বিস্ফোরণ ও তাতে প্রাণহানির এটি দ্বিতীয় ঘটনা বলে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের দাবি। তাঁদের হিসেবে রাজ্যে এ ধরনের প্রথম ঘটনাটি ঘটে ২০১২-র ৮ এপ্রিল, কলকাতার মেটিয়াবুরুজের লোহা গলির মসজিদ তালাওয়ে। বর্ধমানের মতো মেটিয়াবুরুজের বিস্ফোরণেও নিহত হন দু’জন। আবার গোয়েন্দাদের সন্দেহ, খাগড়াগড়ে আইইডি তৈরির কারখানায় অসাবধানতার কারণেই বিস্ফোরণ হয়েছে, ঠিক যেমনটি হয়েছিল মেটিয়াবুরুজে।

দু’টি বিস্ফোরণের ঘটনাতেই জঙ্গিদের লক্ষ্য আসলে কলকাতা ছিল কি না, জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ) তা খতিয়ে দেখতে শুরু করেছে। তবে আরও অনেক দিক থেকে দুই ঘটনার মিল পাচ্ছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণে নিহত দু’জনের এক জন, শাকিল আহমেদ ওরফে নইম বছর তিনেক আগে মেটিয়াবুরুজে দর্জির কাজ করত। পরবর্তী সময়ে সে মুর্শিদাবাদের বেলডাঙায় আইইডি-র কারখানা তৈরি করে। মেটিয়াবুরুজ বিস্ফোরণের তদন্তে নেমে কলকাতা পুলিশের ‘স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স’ (এসটিএফ)-এর গোয়েন্দারা হারুন রশিদ নামে সিমি (স্টুডেন্টস ইসলামিক মুভমেন্ট অফ ইন্ডিয়া)-র এক চাঁইকে ২০১২-র জুলাইয়ে গ্রেফতার করেন।

জেরায় গোয়েন্দারা জানেন, হারুন ছিল নিষিদ্ধ সংগঠন সিমি-র একদা সভাপতি মহম্মদ মিসবা-উল-ইসলামের ঘনিষ্ঠ। আবার মিসবার বাড়ি মুর্শিদাবাদেই, বেলডাঙার অদূরে। এ দিকে খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণে জখম আব্দুল হাকিম ওরফে হাসানের মামাবাড়ি মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুরের ফুলতলায়। যেখানে ভারতে বহু জঙ্গি হানার মাথা আব্দুল করিম টুন্ডার এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের বাড়ি। সব মিলিয়েমেটিয়াবুরুজের বিস্ফোরণ, হারুন, সিমি-র পুরনো কয়েক সদস্যের জড়িত থাকা ও খাগরাগড়ের এই বিস্ফোরণ সবই এক সূত্রে গাঁথা বলে গোয়েন্দাদের একাংশের সন্দেহ। কারণ, বর্ধমানের ঘটনায় ‘আল জিহাদ’ নামে আল কায়দার যে শাখা সংগঠনের কথা প্রাথমিক ভাবে উঠে আসছে সেটি সিমির-ই পুরনো কিছু সদস্যদের নিয়ে গঠিত বলে তদন্তকারীদের ধারণা।

তদন্তকারীরা ইতিমধ্যেই বেলডাঙার বরুয়া মোড়ে শাকিল গাজির একটি দোকানঘর থেকে জেহাদ সংক্রান্ত নথি বাজেয়াপ্ত করেছেন। খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণস্থল থেকে শাকিল গাজির একটি ‘বিজনেস কার্ড’ পাওয়া গিয়েছে। তার সূত্র ধরেই হদিস মিলেছে বেলডাঙার ওই দোকানঘরের। গোয়েন্দাদের বক্তব্য, কাপড়ের দোকানের আড়ালে সেখানে চলত জেহাদি কার্যকলাপ।

মেটিয়াবুরুজের সেই বিস্ফোরণের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা একাধিক গোয়েন্দা খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণস্থল ঘুরে দেখেছেন। তাঁদের বক্তব্য, মেটিয়াবুরুজে আইইডি তৈরির সময়ে অসাবধানতায় বিস্ফোরণ ঘটেছিল এবং ঘরে মজুত অন্য বিস্ফোরক পদার্থ ফেটে যাওয়ায় লম্বায় ১১ ফুট, চওড়ায় ১০ ফুট ও আট ইঞ্চি পুরু দেওয়াল ধসে যায়। পক্ষান্তরে, খাগড়াগড়ে একটি আইইডি কোনও ভাবে ফেটে মারাত্মক ফল হয়েছে। রক্ত-মাংস ছাদে আটকে গিয়েছে। কিন্তু তৈরি হয়ে যাওয়া অন্য আইইডি এবং বিস্ফোরক এত সতর্ক ভাবে রাখা হয়েছিল যে, তুমুল বিস্ফোরণের পরেও সেগুলি অক্ষত। জনবহুল এলাকায় বিস্ফোরণ ঘটলে ১০-১২ জনের প্রাণহানি হতো বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।

খাগড়াগড়ের মতোই মেটিয়াবুরুজের ঘটনায় পুলিশ প্রথমে ঘটনাস্থলে ঢুকতে বাধা পেয়েছিল বলে অভিযোগ ওঠে। পরে পুলিশ যখন ঘটনাস্থলে ঢোকে, ততক্ষণে বহু প্রমাণ লোপাট হয়ে গিয়েছে বলে গোয়েন্দাদের একাংশের দাবি। বেশ কিছু দিন পর্যন্ত ওই ঘটনাকে মামুলি বোমা বিস্ফোরণ বলে চালানোর চেষ্টা করা হয় বলে অভিযোগ। কিন্তু বিস্ফোরণের পরে ক্ষয়ক্ষতি দেখে ও ঘটনাস্থল ঘুরে কিছু তথ্য জোগাড় করার পর অন্য গন্ধ পায় এসটিএফ। তার পরেই খোঁজ শুরু হয় হারুনের। জুলাইয়ে হারুন গ্রেফতার হওয়ার এক মাসের মধ্যেই শিয়ালদহের একটি হোটেলে ওই ব্যক্তির মজুত করে রাখা বিস্ফোরক উদ্ধার করেন গোয়েন্দারা।

মেটিয়াবুরুজে হারুনের মতোই খাগড়াগড়ের ঘটনায় খোঁজা হচ্ছে কাওসার নামে এক ব্যক্তিকে। গোয়েন্দাদের দাবি, তাঁরা জানতে পেরেছেন, নম্বর প্লেটবিহীন লাল রঙের একটি মোটরবাইকে করে ওই ব্যক্তি ঘন ঘন খাগড়াগড়ের ওই ‘কারখানা’ থেকে নিয়মিত ‘মালপত্র’ নিয়ে যেত কাপড়ের আড়ালে। এমনকী, ঘটনার আগের দিনও ওই লোকটি প্রচুর মালপত্র নিয়ে গিয়েছে বলে গোয়েন্দাদের দাবি। তবে তদন্তকারীদের একাংশের ধন্দ, নম্বর প্লেটহীন মোটরবাইক স্থানীয় বর্ধমান টাউন থানার পুলিশের চোখ এড়িয়ে দিনের পর দিন চলাচল করল কী করে? গোয়েন্দাদের বক্তব্য, খাগড়াগড়ের ওই কারখানা থেকে তৈরি আইইডি ইতিমধ্যেই কাদের হাতে পৌঁছে গিয়েছে, তা অবিলম্বে জানা না গেলে বড় বিপদের সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে।

তবে এই ঘটনা নজরদারির ক্ষেত্রে ভাবনাচিন্তায় বদল আনবে বলে মনে করছেন গোয়েন্দাদের একাংশ। আইবি-র এক কর্তার বক্তব্য, এ ধরনের সন্ত্রাসবাদীদের উপরে নজরদারির জন্য মুর্শিদাবাদ, মালদহ, নদিয়া, উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা ও দার্জিলিং জেলার একাংশকে বেছে নেওয়া হতো এত দিন। কিন্তু প্রথমে মেটিয়াবুরুজ, পরে বর্ধমানে আইইডি কারখানার হদিস মেলার পরে ওই গোয়েন্দা-কর্তা মানছেন, “এ বার থেকে সব জেলাতেই নজরদারি বাড়াতে হবে। কোথাও ঢিলে দেওয়া যাবে না।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE