Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

নজিরবিহীন নাটক সিবিআই অফিসে, অফিসারদের পাকড়ে গাড়িতে তুলল পুলিশ

রাজপথে সিবিআই অফিসারদের কার্যত ধাক্কা মারতে মারতে গাড়িতে তুলছে কলকাতা পুলিশ!

সিপি-র বাড়ির সামনে সিবিআই ডিএসপি তথাগত বর্ধনের সঙ্গে কলকাতা পুলিশ আধিকারিকদের বচসা। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।

সিপি-র বাড়ির সামনে সিবিআই ডিএসপি তথাগত বর্ধনের সঙ্গে কলকাতা পুলিশ আধিকারিকদের বচসা। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০৩:৩০
Share: Save:

এমন নাটকীয় ঘটনাপ্রবাহ সম্ভবত আগে দেখেনি রাজ্য!

রাজপথে সিবিআই অফিসারদের কার্যত ধাক্কা মারতে মারতে গাড়িতে তুলছে কলকাতা পুলিশ! রবিবার সন্ধ্যায় বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার তদন্তে কলকাতার পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারের বাড়িতে বসে কথা বলতে চেয়েছিলেন কেন্দ্রীয় সংস্থার তদন্তকারীরা। তাতে বাধা দেয় কলকাতা পুলিশ। তা নিয়েই কথা কাটাকাটি এবং পরে ধাক্কাধাক্কি!

তবে এখানেই শেষ নয়। সন্ধ্যায় নিজাম প্যালেসে সিবিআইয়ের আঞ্চলিক যুগ্ম অধিকর্তা পঙ্কজ শ্রীবাস্তবের সরকারি আবাসনও প্রথমে ঘিরে ফেলে কলকাতা পুলিশ। বিধাননগর পুলিশ ঘিরে ফেলে সল্টলেকের সিজিও কমপ্লেক্সে সিবিআই দফতরও।

নাটকীয়: সল্টলেকের সিজিও কমপ্লেক্সে প্রথমে যায় পুলিশ।

উত্তেজনা চরম পর্যায়ে পৌঁছয়, যখন সন্ধ্যাতেই সিপি-র বাসভবনে হাজির হন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতার মেয়র ও পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, নিরাপত্তা উপদেষ্টা সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ, রাজ্য পুলিশের ডিজি বীরেন্দ্র এবং এডিজি (আইনশৃঙ্খলা) অনুজ শর্মা। সূত্রের খবর, সিপি-র বাড়িতে বৈঠক করেন তাঁরা। পরে মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিক বৈঠক করেন এবং মেট্রো চ্যানেলে ধর্নায় বসেন। সারা দেশ তত ক্ষণে তোলপাড়। এমন ‘বিশৃঙ্খলা’ কী করে হল, রাতে তা জানতে চান রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী। রাজভবনে গিয়ে তাঁকে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন মুখ্যসচিব মলয় দে এবং ডিজি।

আরও পড়ুন: সিপি-র বাড়িতে সিবিআই হানা নিয়ে কেন্দ্র-রাজ্য চূড়ান্ত সংঘাত, ধর্নায় মমতা

মুখ্যমন্ত্রীর সাংবাদিক বৈঠকের পরেই অবশ্য কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দাপ্রধান প্রবীণ ত্রিপাঠী দাবি করেন, ‘‘ওঁরা নিজেদের সিবিআই অফিসার বলে পরিচয় দিলেও সমন বা নির্দেশিকা দেখাতে পারেননি। বলেন, গোপন অভিযানে এসেছেন। তাই এই গোলমাল।’’ পরে পঙ্কজ শ্রীবাস্তব পাল্টা দাবি করেন, ‘‘অনেক তথ্যপ্রমাণ নষ্ট করা হয়েছে। সেই বিষয়েই প্রশ্ন করতে চাইছিল সিবিআই। যথেষ্ট নথিপত্র নিয়েই যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু পুলিশ কোনও সহযোগিতা করেনি।’’

এ দিকে বাড়ির সামনে থেকে সিবিআইকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর রাজীব কুমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে শেক্সপিয়র সরণি থানায় যান। সেখানে তিনি অন্য অফিসারদের সঙ্গে কথা বলেন বলে সূত্রের দাবি।

সল্টলেকের সিজিও কমপ্লেক্সে কেন্দ্রীয় বাহিনী।

সারদা-সহ বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার তদন্তে কলকাতার পুলিশ কমিশনারকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চায় সিবিআই, এমন খবর এ দিন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। বিকেল ৪টেয় লালবাজারের সাংবাদিক বৈঠক ডেকে সেই খবরের সত্যতা খারিজ করেন কলকাতার অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (১) জাভেদ শামিম। ‘ভুয়ো খবর’ প্রকাশের অভিযোগ তুলে তিনি সংবাদমাধ্যমের একাংশের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা ও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকিও দেন। তার দু’ঘণ্টা পেরোতে না-পেরোতেই লাউডন স্ট্রিটে সিপি-র সরকারি বাসভবনে হাজির হয় সিবিআই।

এ দিন সন্ধ্যা ৬টার কিছু ক্ষণ আগে সিপি-র বাসভবনের সামনে হাজির হন কলকাতার ডিসি (সাউথ) মিরাজ খালিদ এবং শেক্সপিয়র সরণি থানার ওসি অমিত দে সরকার। ৬টা নাগাদ সিবিআইয়ের ডিএসপি তথাগত বর্ধনের নেতৃত্বে ৮ জনের একটি দল লাউডন স্ট্রিটে পৌঁছয়। তাঁরা বাসভবন থেকে একটু দূরে গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে সিপি-র বাড়ির সামনে পৌঁছতেই পুলিশ আটকায় এবং আগমনের কারণ জানতে চায়।

ধর্মতলায় ধর্নামঞ্চে রাজীব কুমার। —নিজস্ব চিত্র।

কে তিনি?
• নাম: রাজীব কুমার
• কলকাতার পুলিশ কমিশনার
• ১৯৮৯ সালের আইপিএস অফিসার
• জন্ম: তৎকালীন উত্তরপ্রদেশে
• শিক্ষাগত যোগ্যতা: বিই
• পশ্চিমবঙ্গ ক্যাডারে যোগ দেওয়ার পর রাজ্য পুলিশ, কলকাতা পুলিশ ও সিআইডি-তে একাধিক পদে কাজ করেছেন। সামলেছেন কলকাতার ডিসি (সেন্ট্রাল), সিআইডির ডিআইজি (অপারেশনস), বিধাননগরের পুলিশ কমিশনারের মতো পদ। দু’দফায় কলকাতার পুলিশ কমিশনার

সারদা ও রাজীব

• ২০১৩ সালে এপ্রিল মাসে সারদা কেলেঙ্কারি ফাঁস হয়। কাশ্মীর থেকে সারদা কর্তা সুদীপ্ত সেন এবং অন্যতম ডিরেক্টর দেবযানী মুখোপাধ্যায়কে গ্রেফতার করে বিধাননগর পুলিশ। বিধানননগরের তৎকালীন কমিশনার রাজীব কুমারের নেতৃত্বে ‘সিট’ গঠন করে তদন্ত শুরু হয়। পরে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তদন্তভার নেয় সিবিআই। সেই তদন্তে রাজীবকে বারবার তলব করা হলেও তিনি সিবিআইয়ের সঙ্গে সহযোগিতা করেননি বলে অভিযোগ।

সিবিআই অফিসারেরা জানান, তাঁরা রাজীবের সঙ্গে কথা বলতে চান। তবে এ ব্যাপারে কোনও নির্দেশিকা দেখাতে পারেননি বলে পুলিশের দাবি। পুলিশ তাঁদের বাড়িতে ঢুকতে না-দিয়ে অদূরে রবিনসন স্ট্রিটের কাছে নিয়ে যায়। সে সময় তথাগত ফোনে উচ্চ পর্যায়ের কর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করেন। অমিত তাঁকে গাড়িতে তুলে থানায় নিয়ে যেতে চান। তথাগত প্রতিবাদ করেন। ইতিমধ্যে মিরাজ, অমিত-সহ উপস্থিত পুলিশকর্তাদের সঙ্গে সিবিআইয়ের আধিকারিকদের কথা কাটাকাটি শুরু হয়। এর মধ্যেই বিভিন্ন জায়গা থেকে বাহিনী নিয়ে আসেন কলকাতা পুলিশের পদস্থ কর্তারা। আনা হয় গুন্ডাদমন শাখার বাছাই করা অফিসারদেরও।

সন্ধ্যা পৌনে ৭টা নাগাদ হঠাৎই সিবিআই আধিকারিকদের উপরে চড়াও হয় কলকাতা পুলিশ। অফিসারদের নেতৃত্বে রীতিমতো ধাক্কা দিয়ে গাড়িতে তোলা হয় কেন্দ্রীয় তদন্তকারীদের। বেগতিক দেখে ‘সিবিআই’ লেখা জ্যাকেট পরে নেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। তাঁদের দু’জন চেঁচাতে শুরু করেন, ‘‘আমরা সিবিআইয়ের অফিসার। আপনারা মারছেন কেন?’’ তাতেও লাভ হয়নি। টেনে, হিঁচড়ে গাড়িতে তুলে তাঁদের শেক্সপিয়র সরণি থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। কার্যত দুর্গের চেহারা নেয় লাউডন স্ট্রিট এবং শেক্সপিয়র সরণি থানা।

মহানগরীর রাস্তায় টিভিতে নিমগ্ন।

ইতিমধ্যে খবর মেলে, নিজাম প্যালেসে সিবিআইয়ের যুগ্ম অধিকর্তার আবাসন ঘিরে ফেলেছে কলকাতা পুলিশ। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ভবানীপুর, বালিগঞ্জ এবং ময়দান থানার পুলিশ ভিড় করেছে। রাত সওয়া ৮টা নাগাদ অবশ্য পুলিশ তুলে নেওয়া হয়। লালবাজার জানায়, শেক্সপিয়র সরণি থানা থেকে সিবিআই অফিসারদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তবে সিবিআই কর্তার বাড়িতে পুলিশ কেন গেল, সল্টলেকের সিজিও কমপ্লেক্সেও বিধাননগর পুলিশের ডিসি (সদর) অমিত জাভালগি এবং গোয়েন্দাপ্রধান আভারু রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে বাহিনী কেন হাজির হল, তারও নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা মেলেনি।

সূত্রের দাবি, সন্ধ্যাতেই দিল্লিতে সিবি‌আইয়ের সদর দফতরে এই ঘটনার খবর পৌঁছয়। লালবাজারের আচরণে ‘ক্ষুব্ধ’ সিবিআই কর্তারা ইতিমধ্যেই রাজ্যপালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চেয়েছেন। ভবিষ্যতে এই ধরনের তদন্তের কাজে আধা-সামরিক বাহিনীকে সঙ্গে রাখার কথাও ভাবছেন কেন্দ্রীয় সংস্থার কর্তারা। রাতেই সিজিও কমপ্লেক্সে, নিজাম প্যালেসে মোতায়েন করা হয়েছে সিআরপিএফ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE