E-Paper

অন্য পুজোর উদ্‌যাপন, ফুটপাতের কিশোরের তৈরি দুর্গা দেখতে ভিড়

পুজোর এক দুপুরে শোভাবাজার রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে জগৎ মুখার্জি পার্কের মণ্ডপের দিকে যেতে চোখে পড়ল ভিড়। কিছু একটা কারণে প্রবল জটলা ফুটপাতের ভিড়ে। পরিস্থিতি সামাল দিতে এসে পড়েছে পুলিশও।

নীলোৎপল বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০২৪ ০৮:৪১
নিজের তৈরি দুর্গা নিয়ে কিশোর সর্দার।

নিজের তৈরি দুর্গা নিয়ে কিশোর সর্দার। —নিজস্ব চিত্র।

বয়স মেরেকেটে ১৫ বছর। বাবা ভ্যান চালান। মা আর বড়দিদি পরিচারিকার কাজ করেন। তৃতীয় শ্রেণির পরে আর তার পড়াশোনা করা হয়নি। কোনও প্রতিষ্ঠান বা কারও কাছে শেখা হয়নি আঁকাও। কিন্তু ফুটপাতে রাত কাটানো সেই ছেলের তৈরি দুর্গাই গত কয়েক দিন ভিড় করে দেখলেন পথচলতি মানুষ। কোনও মণ্ডপে নয়, শহরের ফুটপাতে। এ যেন আদতে এক ‘অন্য পুজোর কার্নিভাল’।

পুজোর এক দুপুরে শোভাবাজার রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে জগৎ মুখার্জি পার্কের মণ্ডপের দিকে যেতে চোখে পড়ল ভিড়। কিছু একটা কারণে প্রবল জটলা ফুটপাতের ভিড়ে। পরিস্থিতি সামাল দিতে এসে পড়েছে পুলিশও। কাছে এগিয়ে দেখা গেল, লোকজন উদ্‌ভ্রান্তের মতো দাঁড়িয়ে পড়েছেন! একটি পুরনো বাড়ির জানলার দিকে অনেকেই তাক করছেন মোবাইল। দেখা গেল, জানলার এক চিলতে জায়গায় আট-দশ ইঞ্চির দুর্গা প্রতিমা। আশপাশে আরও ছোট লক্ষ্মী, গণেশ, কার্তিক, সরস্বতী। অসুর রয়েছে প্রতীকী হিসাবে। দু’টাকার কয়েনের মাপের মাটির চাকতি তৈরি করে তাতে নাক-মুখ-চোখ আঁকা। তার সামনে ষাঁড়ের মাথা বসানো। তবে নৃত্যের ভঙ্গিমায় থাকা দেবীর হাতে অস্ত্র নেই। গলায় পুরনো মালা। সামনে ছোট গ্লাসে রাখা জল আর থালায় বাতাসা।

কে করেছেন এই পুজো? কার বানানো দুর্গা? শিল্পীর নাম কিশোর সর্দার। ৬১, যতীন্দ্রমোহন অ্যাভিনিউয়ের বহুতলের সামনের ফুটপাতে তার বাস। সেখানেই মাটিতে ছেঁড়া বস্তা পেতে, তার উপরে বসে আলোর শহরে কী যেন এঁকে চলেছিল সে। লোকের প্রশ্নে জেরবার হয়ে এক সময়ে সে হাঁটা দিল অন্য দিকে। পরের দিন সকালে সেখানে ফের দেখা গেল, ভিড় কিছু কম। রয়েছে সেই দুর্গামূর্তি। পথচলতি দর্শনার্থীর কারও চোখে পড়ছে, কারও নজর এড়িয়ে যাচ্ছে। দেখা মিলল কিশোরের বাবা কৃষ্ণ সর্দারের। ভ্যান চালিয়ে ক্লান্ত কৃষ্ণ তখন বিশ্রাম নিচ্ছেন। একই ভাবে বিশ্রামরত কিশোরের দুই দিদি লক্ষ্মী, সীমা এবং মা মায়া সর্দার। সীমা বলেন, ‘‘সারা রাত এত লোকে ঠাকুর দেখতে আসেন যে ফুটপাতে খুব ভিড় হয়। তখন ঘুমোনো যায় না। তাই সকালটাই একটু ঘুমোনোর সময়।’’

সীমা বলে চলেন, ‘‘আমরা চার ভাই-বোন। বাবার ভ্যান চালানোর টাকায় সংসার চলে না। মায়ের সঙ্গে তাই আমিও লোকের বাড়ি কাজে যাই। বোন এখানেই থাকে। ভায়েরা তেমন কিছু করে না। তবে কিশোর খুব ভাল আঁকে। কারও কাছে শেখেনি। আর শেখাবেই বা কে! গত কয়েক বছর ধরে ওর ঠাকুর বানানোর ঝোঁক হয়েছে। কালী ঠাকুর, সরস্বতী ঠাকুর— সব বানায় ভাই। এ বার দেখছি দুর্গা ঠাকুরও বানিয়েছে।’’

এত ক্ষণ চুপ করে শুনছিলেন কিশোরের মা। এ বার বললেন, ‘‘ছেলেটা কী করে যে এ সব করে, জানি না। মেট্রোপলিটন স্কুলে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিল। ওর বাবা আর টানতে পারেনি। পরে একটা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার স্কুলে যেত। লকডাউন থেকে সেটাও বন্ধ। আর পড়ালেখা হয়নি। ঠাকুর বানিয়ে যদি কিছু আয় করে, তাই বাধা দিই না।’’

দুর্গাপুজোর কয়েক দিন আগে খাতায় প্রতিমা আঁকতে শুরু করেছিল কিশোর। এর পর গঙ্গা থেকে মাটি তুলে এনে প্রতিমা বানাতে শুরু করে। চতুর্থীর দিন ঠাকুর বানানো শেষ হয়। ওর দিদি লক্ষ্মীকে দিয়ে এর পর রং করায় প্রতিমায়। কিশোর বলে ওঠে, ‘‘ভিড়ের ধাক্কায় ঠাকুর রাখাই যাচ্ছিল না। আর একটু হলে পড়ে গিয়ে ঠাকুরের হাত ভেঙে যাচ্ছিল। অনেকে ঠাকুরটা নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। টাকাও দিতে চাইছিলেন। কিন্তু বিক্রি করিনি।’’ এর পরেই কিশোরের উক্তি, ‘‘আঁকা শিখতে চাই। ঠাকুর গড়তে চাই। এক দিন দুর্গাপুজোর শিল্পী হব। খুব ইচ্ছে, আমার তৈরি ঠাকুর দেখতেও ভিড় হোক।’’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Durga Puja 2024 Durga Puja Footpath

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy