E-Paper

আঁধার জীবনে কোথাও ক্ষীণ আলোকরেখা, কোথাও ঘোর অমাবস্যা

গত বছরের অগস্টের ঘটনা। বাগুইআটি থানা এলাকার জগৎপুরের বাসিন্দা অতনু দে ও তার পিসতুতো ভাই অভিষেক নস্করকে নৃশংস ভাবে খুন করে কয়েক জন দুষ্কৃতী।

প্রবাল গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০২৩ ০৯:০৬
An image of death

—প্রতীকী চিত্র।

বিবর্ণ পৃথিবীতে খানিকটা রঙের ছিটে লেগেছে। কিন্তু এক মাসের একরত্তি কি পারবে সেই বিবর্ণ পৃথিবীটা পুরোপুরি রাঙিয়ে তুলতে? একমাত্র ছেলে নৃশংস ভাবে খুন হওয়ার পরে সব এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল জগৎপুর বাজার এলাকার বাসিন্দা টুকটুকি দে এবং বিশ্বনাথ দে-র। কিন্তু স্বামী-স্ত্রীকে ফের জীবনমুখী করতে ভরসার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন দুই পরিবারের দুই বৃদ্ধা। তাঁরা পাশে থাকায় দুর্গাপুজোর আগে আবারও সন্তানের মুখ দেখেছেন ওই দম্পতি। সেই সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে আবারও জীবনে বাঁচার অর্থ খোঁজার চেষ্টা করছেন টুকটুকি ও বিশ্বনাথ। তবু ভুলতে পারেন না ১৬ বছরের ছেলে অতনুর মুখ।

গত বছরের অগস্টের ঘটনা। বাগুইআটি থানা এলাকার জগৎপুরের বাসিন্দা অতনু দে ও তার পিসতুতো ভাই অভিষেক নস্করকে নৃশংস ভাবে খুন করে কয়েক জন দুষ্কৃতী। দু’জনে দু’টি স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র ছিল। মোটরবাইক কেনাকে ঘিরে গোলমালের জেরে পাড়ারই বাসিন্দা এক যুবক ও কয়েক জনের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ ওঠে। অতনুকে তুলে নিয়ে যাওয়ার সময়ে অভিষেক তার সঙ্গে ছিল। ঘটনার কোনও সাক্ষী না রাখতে তাকেও খুন করা হয়। পরে বসিরহাট এলাকার দু’টি জায়গা থেকে তাদের দেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

জগৎপুরে বিশ্বনাথের বাড়িতে গিয়ে জানা গেল, অতনুর মৃত্যুর পরে টুকটুকি সাংঘাতিক ভেঙে পড়েছিলেন। বাড়ির দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন বিশ্বনাথের বৃদ্ধা মা সরস্বতী। কথা বলতে বলতে বুক ভরা ক্ষোভ উগরে দেন। বলেন, ‘‘মানুষ এত নৃশংস হতে পারে? ওইটুকু দুটো বাচ্চাকে এ ভাবে খুন করল! বৌমার আবার একটা মেয়ে হয়েছে। না হলে কাকে আশ্রয় করে বাঁচবে? ছেলের তো তা-ও চাকরি আছে, বাইরের জগৎ আছে। মেয়েটার তো ওই ছেলেটা ছাড়া কেউ ছিল না। এক বছর হয়ে গেল। এখনও ওদের সাজা হল না। ওদের যেন ফাঁসি হয়।’’

আপাতত জগৎপুরের বাড়িতে বৃদ্ধা মাকে নিয়ে রয়েছেন বিশ্বনাথ। কিছু দূরে নিজের মায়ের কাছে আছেন টুকটুকি। তিনি কথা বলতে চাননি। তবে তাঁর মা সুধা বিশ্বাস বলেন, ‘‘১৬ বছরের ছেলে কী করেছিল যে, তাকে খুন করতে হল! ছোট্ট মেয়েটার দিকে চেয়েও মেয়ের মুখে হাসি নেই। নাতির কথা মনে করে সব সময়ে কাঁদে। জানি না, দোষীরা কত দিনে সাজা পাবে।’’

একই প্রশ্ন অভিষেকের বাবা-মায়ের। সন্তানশোক ভোলার চেষ্টা করেও প্রতিদিন ব্যর্থ হন তাঁরা। বাড়ির একতলায় রাখা সাইকেল থেকে দোতলার ঘরের আনাচ-কানাচে ছড়িয়ে থাকা নানা জিনিসপত্রে নস্কর দম্পতির একমাত্র ছেলের স্মৃতি। কখনও ছেলের জন্য আনা অ্যাকোয়ারিয়ামের দিকে চেয়ে কেঁদে ওঠেন বাবা হরি নস্কর। কখনও ছেলের ছবি দেখে চোখের জল বাঁধ মানে না মা কমলার। ছেলের মৃত্যুর পরে দুধের ব্যবসা বন্ধ করে আপাতত ঘরবন্দি হরি। সন্ধ্যায় তাঁর আশ্রয় পাড়ার মন্দিরের চাতাল। দুর্গাপুজো মানে আর উৎসবের আনন্দ নয়, বরং আড়ালে থাকাই দস্তুর তাঁদের কাছে।

হরি বলেন, ‘‘যে ছেলেটা রাজসাক্ষী হল, আদালতে দাঁড়িয়ে সে বলেছিল, কী ভাবে ছেলের গলায় তার জড়িয়ে খুন করেছে। বুকটা ভেঙে যাচ্ছিল সেই বর্ণনা শুনতে শুনতে। জানি না, দোষীরা কত দিনে সাজা পাবে। এখন পুজো মানে আমি মন্দিরে আর আমার স্ত্রীর ঘর বন্ধ করে একা বসে থাকা। সব শেষ হয়ে গিয়েছে। সব।’’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Death Tragedy Murder

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy