Advertisement
E-Paper

পেয়েছি অনেক, হারিয়েছে আন্তরিকতা ও মূল্যবোধ

অশোক ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০১৫ ০০:৩০
ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য।

ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য।

সত্তর দশকের শেষের দিক। সবে মাত্র এমবিবিএস পাস করেছি। থাকি ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের হাউসস্টাফ কোয়ার্টার্সে। এক চিকিৎসক দাদা প্রায় ‘হাইজ্যাক’ করে নিয়ে এলেন পর্ণশ্রীতে, বিবেকানন্দ হাসপাতালের আরএমও করে। তিনি অন্যত্র চলে যাবেন। কিন্তু পদ তো খালি রাখা যায় না! বললেন, ‘‘চল কয়েক দিনের জন্য। ভাল লাগলে থাকবি।’’ আমি থেকেই গেলাম।

গিন্নি এলেন। সংসার হল। বাসস্থানের দরকার ছিল। পর্ণশ্রীতে জায়গা কিনে বাড়ি করলাম। এখানে তখন প্রায় কিছুই ছিল না। তার পরে সব ধীরে ধীরে বদলে গেল। জল, রাস্তাঘাট, যানবাহন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা— যোগ্য বাসস্থানের জন্য চাণক্য এই কয়েকটি মাপকাঠির কথা বলেছিলেন। এই সময়ে দাঁড়িয়েও এই মাপকাঠিগুলিকে আমার যথার্থ মনে হয়। সেই নিরিখে বিচার করলে বোঝা যাবে পর্ণশ্রীর উন্নয়ন কোন পথে এগিয়েছে।

আগে কুয়োর জলে কাজ চালাতাম। পানীয় জল আনতে হত বাইরে থেকে। এখন তো বাড়ি বাড়ি জল আসছে। নতুন নতুন বুস্টার পাম্পিং স্টেশন তৈরি হয়েছে। সেই কবে বাড়ির সামনে ঘেঁষ ফেলে রাস্তা করেছিলাম। চারপাশ জঙ্গলে ভর্তি ছিল। মাত্র পাঁচটা বাড়ি ছিল। গিন্নি, ছেলে-মেয়েরা যখন ফিরত, তখন কাশবনের ভিতর দিয়ে শুধু মাথাটুকু দেখতে পেতাম। সেখানে এখন ঝকঝকে রাস্তা। কিন্তু সেই রাস্তায়ই যখন সচেতনতার অভাবে নোংরা হতে দেখি তখন খারাপ লাগে।

আগে জায়গাটা ছিল খুবই নির্জন। দুপুর ২টো থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত পুরো এলাকা সুনসান হয়ে থাকত। দুপুরের দিকে দোকানপাট বন্ধ হয়ে যেত। সন্ধ্যার পরে মাত্র দু’ঘণ্টার জন্য খুলত। রাত ৮টা বাজলেই সব নিঝুম। এখন রাতেও চারপাশ আলো ঝলমলে। বাইরের থেকে ট্যাক্সি আসতে চাইত না। স্টেট গ্যারাজ থেকে রাতে হেঁটে আসত হত। বাস বলতে ছিল ১৩ নম্বর রুট। এখন কত রুটের বাস চলছে। আছে পর্যাপ্ত অটো। ট্যাক্সি ঢুকতেও আপত্তি করে না। রয়েছে রেলস্টেশন। বেহালা ফ্লাইং ক্লাবে বিমানবন্দর তৈরি হচ্ছে। ফলে বসবাসের জন্য পর্ণশ্রী আদর্শ হয়ে উঠছে। পর্ণশ্রীর এই পাল্টে যাওয়ার পিছনে মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে।

এই উন্নয়নের জন্যই ধীরে ধীরে জনবসতি বেড়েছে। নতুন নতুন স্কুল, কলেজও গড়ে উঠছে। আমার সেই ছোট বিবেকানন্দ হাসপাতাল বড় হয়েছে। এখন এখানে জেনারেল, অর্থোপেডিক অস্ত্রোপচার হয়। পাশের বিদ্যাসাগর হাসপাতালেরও উন্নয়ন হয়েছে। সেখানে রিকভারি ওয়ার্ড খোলা হয়েছে। তবে, পরিষেবার মান আরও উন্নত করা দরকার। কিন্তু এই বদলের ছাপ পড়েনি পর্ণশ্রীর বাজারে। পর্ণশ্রীর শুরুর থেকেই বাজারটি রয়েছে। পুরসভা শহরের বাজারগুলির সংস্কার করছে। যদি এই বাজারটির সংস্কার হয়, তা হলে বাসিন্দাদের খুব সুবিধা হয়।

চিকিৎসক বলে এলাকার আমাকে সকলেই চেনেন। খাতিরও করেন। তবে আগের সেই অন্তরঙ্গতা খুব একটা চোখে পড়ে না। মনে আছে আমার প্রথম সন্তান জন্মানোর আগে এক দিন এক রোগী খুব বিনীত ভাবে বললেন, ‘‘আপনি ডাক্তার। বলা উচিত নয়। তবুও বলছি। আপনাকে একটা কথা বলব? গাড়ির ব্যবস্থা করে রেখেছেন তো? গাড়ির অভাবের জন্য অনেক দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে।’’ তিনি আমার বিশেষ পরিচিত ছিলেন না। কিন্তু আমাকে নিজের মনে করে কথাটা বলেছিলেন। আমাকে খুব ছুঁইয়ে গিয়েছিল। এই আন্তরিকতা আজ আর দেখা যায় না।

আজকাল সচেতনতার অভাবটাও নাড়া দেয়। যেমন, মোটরবাইক নিয়ে যাওয়ার সময়ে জোরে হর্ন বাজানো। মাঝে মাঝে রাতেও নিস্তার মেলে না। এলাকায় অসুস্থ, বয়স্ক, সন্তানসম্ভবা মহিলা, বাচ্চাদের কথা এঁরা মাথায় রাখেন না। হয়তো চিকিৎসক বলেই যত্রতত্র থুথু ফেলাও মেনে নিতে পারি না। ওই থুথু থেকে কত জীবাণু ছড়াতে পারে। এ নিয়ে কি একটু সচেতন হতে পারি না? কোথাও যেন মূল্যবোধের ঘাটতি হচ্ছে।

শোভনবাবু যে ক’টি প্রকল্প হাতে নিয়েছেন, তা সম্পূর্ণ করেছেন। কিন্তু সব তো সরকার করে দিতে পারে না। আমাদেরও সচেতন হতে হবে, দায়িত্বশীল হতে হবে। পুরসভা সব করে দেবে, আর আমরা নোংরা করব— এই মানসিকতা বদলাতে হবে।

লেখক বিশিষ্ট চিকিৎসক

doctor ashok ghosh behala kolkata
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy