E-Paper

‘পাগল’ তকমা মুক্ত হয়ে ন্যায়যুদ্ধ তরুণীর 

পাভলভের কর্তারা বলছেন, ভর্তির সময় থেকেই মেয়েটির বলতে গেলে ওষুধই লাগত না কোনও। অসুস্থতার চিহ্ন নেই। বিধ্বস্ত অন্য আবাসিকদের পাশে পরিষ্কার, ফিটফাট মেয়েটিকে চেনা যেত সহজেই।

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ০৮ অগস্ট ২০২৩ ০৬:১২
An image of the lady

লড়াকু: নতুন আশ্রয়ে শিশুকন্যা। — নিজস্ব চিত্র।

স্বাধীনতার মাসে আত্মমর্যাদায় ঘাড় সোজা করার স্পর্ধা। নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে স্বামী, শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার, লাথিঝাঁটার জীবন থেকেও বেরোনোর সাহস। রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তাদের একাংশের কাছে ‘শিশুকন্যা সাহা’ নামটিই এখন নাছোড় জেদের প্রতীক। ‘পাগল’ সাজিয়ে ২০২২-এর এপ্রিলে শ্বশুরবাড়ি এবং পুলিশের একাংশের যোগসাজশে তাঁকে পাভলভ হাসপাতালে ‘চালান’ করা হয়েছিল বলেই তরুণীর অভিযোগ।

হাসপাতাল থেকে তিনি তো বেরিয়েইছেন! একটি বেসরকারি হোমের আশ্রয়ে থেকে নতুন করে শ্বশুর শোভন সাহা, স্বামী শুভজিতের নামে পুলিশে অভিযোগও দায়ের করেছেন। সম্প্রতি শ্রীরামপুর আদালতে গোপন জবানবন্দি দিয়েছেন শিশুকন্যা। বলছেন, “আগে কত বার বেধড়ক মার খেয়েও ঘর করব বলে ফিরে গেছি! আর সেটা সম্ভব নয়!”

পাভলভের কর্তারা বলছেন, ভর্তির সময় থেকেই মেয়েটির বলতে গেলে ওষুধই লাগত না কোনও। অসুস্থতার চিহ্ন নেই। বিধ্বস্ত অন্য আবাসিকদের পাশে পরিষ্কার, ফিটফাট মেয়েটিকে চেনা যেত সহজেই। অথচ সাঁকরাইল থানার পুলিশ কোর্টের মাধ্যমে এ মেয়েকে ‘পাগল’ বলে হাসপাতালে পাঠায়। শিশুকন্যার দাবি, শ্বশুরবাড়ির মারধর সইতে না-পেরে সাঁকরাইল থানায় শ্বশুরের বন্ধু এক অফিসারের সাহায্য নিতে যান তিনি। ‘পাগল’ বলে দাগিয়ে পুলিশ তাঁকে অন্য নামে আদালতের মাধ্যমে পাভলভে পাঠায় বলে হাসপাতাল সূত্রেরও খবর। অভিযোগকারিণীর শ্বশুরকে বার বার ফোন করেও সাড়া মেলেনি। কী ঘটেছিল, তার যথাযথ তদন্ত চলছে বলেই আশ্বাস দিচ্ছে পুলিশ।

শিশুকন্যার মা ও বাবা বিবাহবিচ্ছিন্ন। মা অসুস্থ, মেদিনীপুরে। বাবা রঘুনাথ দাস বালেশ্বরে থাকেন। খবর পেয়ে ২০২২-এর জুলাইয়ে এসে তিনি শিশুকন্যাকে নিয়ে যান। তখন উত্তরপাড়া থানায় স্বামী, শ্বশুরের নামে বধূ নির্যাতনের অভিযোগও শিশুকন্যা দায়ের করেছিলেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘এর পরে ফোনে শ্বশুরমশাইয়ের কান্নাকাটিতে ভুলেই ফের উত্তরপাড়ায় সংসার করতে যাই। অভিযোগও তুলে নিই। কিন্তু জীবন পাল্টায়নি। ফের মারধর, অপমান। চোর বা পাগল সাব্যস্ত করার চেষ্টা। স্থানীয় পুলিশের সহযোগিতা মেলেনি। নিরুপায় হয়ে পাভলভের ডেপুটি সুপার সেবন্তীদি (মুখোপাধ্যায়) আর এনজিও-র দিদিদের কাছেই ফিরে যাই।’’

শিশুকন্যার এ কাহিনী নিছকই নারী নির্যাতনের ঘটনা নয়! বিপদে পাশে থাকা, হাত বাড়ানোরও গল্প! গত ২৪ এপ্রিল মার খেয়ে পাভলভে ফেরেন কাহিল শিশুকন্যা। সুপার মৃগাঙ্কমৌলী কর সঙ্গে সঙ্গে চতুর্থ শ্রেণির কর্মী দীপেন প্রধানের সঙ্গে মেয়েটিকে ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য পাঠান। তপসিয়া থানায় সব জানানোও হয়। কিন্তু কোথায় থাকবেন শিশুকন্যা? পাভলভে সক্রিয় মানসিক রোগীদের ক্ষমতায়নের শরিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার শুক্লা দাস বড়ুয়া, অনিন্দিতা চক্রবর্তীরা মেয়েটিকে তাঁদের পরিচিত একটি বৃদ্ধাবাসে পাঠান। বৃদ্ধাবাসের কর্ত্রী দুর্গা নস্কর মায়ের মতো তাঁর পক্ষপুটে মেয়েটিকে আশ্রয় দিয়েছেন। এর মধ্যে দু’বার শ্বশুরবাড়িতে ফেরার চেষ্টা করেও শিশুকন্যা বিফল। হাসপাতালের অনুরোধে জেলা আইনি পরিষেবা কর্তৃপক্ষ (ডিএলএসএ) এবং মহিলা কমিশনও এ বার মাঠে নেমেছে। ডিএলএসএ-র তরুণী কর্মী অঙ্কিতা নাগ মেয়েটির হয়ে দৌড়ঝাঁপ করছেন। শিশুকন্যা অবাক, ‘‘আগে কথা না শুনলেও পুলিশ এখন আমায় 'ম্যাডাম’ বলে ডাকছে!”
তবে পুলিশ বা আদালতের মাধ্যমে মানসিক হাসপাতালে যথেচ্ছ রোগী ভর্তির বিষয়টি নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। সমাজকর্মী রত্নাবলী রায়ের প্রশ্ন, “কী দেখে মেয়েটিকে ভর্তি করানো হয়েছিল, তা রহস্যজনক! রাজ্যে নতুন মানসিক স্বাস্থ্য আইন চালু হলে পুলিশ বা কোর্টের উপরে নির্ভর করতে হত না! মনোরোগীদের বিষয়ে মেন্টাল হেলথ রিভিউ বোর্ডই সুবিচার করত! বোর্ড গড়ার চেষ্টা না-করে কেন হাসপাতালে আবাসিকের গাদাগাদি মেনে নেওয়া হচ্ছে, তা-ও বেশ অদ্ভুত!”

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Domestic Violence Mental Health Pavlov Hospital torture

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy