Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Acid Attack

Acid Attack: ‘এমন লঘু দণ্ডে লড়াই করার শক্তিটাই হারাবেন ওঁরা’

অ্যাসিড হামলার ক্ষেত্রে বর্তমানে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩২৬(এ) ধারায় সর্বনিম্ন ১০ বছরের জেল এবং সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাবাসের কথা বলা রয়েছে।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

স্বাতী মল্লিক
কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০২১ ০৭:৩৪
Share: Save:

ভরসন্ধ্যায় দরজায় দাঁড়ানো মহিলার সঙ্গে কথা-কাটাকাটি শুরু করেছিল তাঁর এক পূর্ব পরিচিত। হঠাৎই গ্লাসে আনা অ্যাসিড সে ছুড়ে দেয় মহিলার দিকে। আক্রান্তের ‘জ্বলে গেল, জ্বলে গেল’ আর্তনাদের মধ্যেই নর্দমায় গ্লাস ছুড়ে ফেলে চম্পট দেয় অভিযুক্ত। ২০০৩ সালে অবিনাশ কবিরাজ স্ট্রিটে সেই অ্যাসিড হামলার মামলায় দীর্ঘ ১৮ বছর পরে রায় দিয়েছে ব্যাঙ্কশাল আদালত। গত সপ্তাহের সেই রায়ে দোষী গোপাল দত্তকে এক মাসের জেল এবং ২০০ টাকা জরিমানার সাজা শুনিয়েছেন বিচারক।

যে দণ্ডের কথা শুনে অ্যাসিড আক্রান্তেরা এক সুরে বলছেন, ‘‘এই রায় শুনে হতাশায় ভুগছি। এর চেয়ে তো সাজা না দেওয়া ভাল ছিল!’’

অ্যাসিড হামলার ক্ষেত্রে বর্তমানে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩২৬(এ) ধারায় সর্বনিম্ন ১০ বছরের জেল এবং সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাবাসের কথা বলা রয়েছে। ২০১৩ থেকে এই সংশোধিত আইন কার্যকর হয়েছে। কিন্তু ২০০৩ সালের এই মামলায় চার্জশিট দেওয়া হয় ২০০৬-এ, যখন কড়া সংশোধিত আইনের অস্তিত্ব ছিল না। ছিল ৩২৬ ধারা, যাতে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের কথা বলা থাকলেও সর্বনিম্ন সাজা কী হতে পারে, তা বলা নেই বলেই জানাচ্ছেন আইনজীবীদের একাংশ। সেই সঙ্গে ওই মামলায় আদালতে সাক্ষ্যপ্রমাণ দাখিল করার ক্ষেত্রেও কিছু ত্রুটি থেকে গিয়েছে। ফলে লঘু দণ্ডের বিধান হয়েছে। হাই কোর্টের আইনজীবী কল্লোল মণ্ডল বলছেন, ‘‘এ ক্ষেত্রে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পরেও বিচারক অনেক দিক বিচার করে যেটুকু সাজা দেওয়া যথার্থ মনে করেছেন, তা-ই দিয়েছেন। তবে চিকিৎসার নথি এবং চিকিৎসককে মামলার সাক্ষী হিসাবে আনার ক্ষেত্রে সরকারি আইনজীবী আরও সচেষ্ট হতে পারতেন বলে মনে হয়।’’

আবার পুলিশে অভিযোগ দায়ের করার সময়েই অনেক ক্ষেত্রে মামলা দুর্বল হয়ে পড়ে বলে জানাচ্ছেন অ্যাসিড আক্রান্তদের নিয়ে কাজ করা সমাজকর্মী দিব্যালোক রায়চৌধুরী। তাঁর কথায়, ‘‘পরিস্থিতির কারণে এফআইআর দুর্বল হয়ে গেলে ফল ভুগতে হয় আক্রান্তদের। এ ছাড়া, আদালতে মামলার পাহাড় জমে থাকায় দীর্ঘায়িত হয় বিচার-প্রক্রিয়া। কোর্টে চক্কর কাটতে কাটতে অনেকেই তাই লড়াই করার ইচ্ছে হারিয়ে ফেলেন।’’

কিন্তু স্রেফ আইনি ধারার মারপ্যাঁচে লঘু শাস্তি পেয়ে পার পেয়ে গেল অপরাধী— এটা হজম করতে পারছেন না মনীষা পৈলান-সঞ্চয়িতা যাদবেরা। ২০১৫ সালে অ্যাসিড হামলার শিকার মনীষা ক্ষোভ উগরে বলছেন, ‘‘হাস্যকর শাস্তি। এর চেয়ে মামলা তুলে নেওয়া ভাল! এই অপরাধ যেন আর একটাও না হয়, সেই দায় কেন সমাজ বা বিচার ব্যবস্থা নেবে না? আর কি কারও দায় নেই?’’ আর দীর্ঘ সাত বছর লড়াইয়ের পরে সুবিচার পাওয়া, লড়াকু সঞ্চয়িতা প্রশ্ন তুলছেন— ‘‘এই রায় শুনলে তো অনেকেই ভাববে যে, অ্যাসিড ছুড়েও সহজে পার পাওয়া যায়! রাজ্যে অ্যাসিড হামলা তা হলে কমবে কী ভাবে?’’

ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরো-র ২০২০ সালের রিপোর্ট বলছে, অ্যাসিড হামলার সংখ্যার দিক থেকে উত্তরপ্রদেশকে পিছনে ফেলে দেশের মধ্যে ফের শীর্ষে উঠে এসেছে পশ্চিমবঙ্গ। ২০১৯ সালে উত্তরপ্রদেশে যেখানে অ্যাসিড হামলার সংখ্যা ছিল ৩০, সেখানে এই রাজ্যে সেই সংখ্যাটা ৫১। যদিও লালবাজারের এক উচ্চপদস্থ কর্তা বলছেন, ‘‘কলকাতা পুলিশ বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। ইতিমধ্যেই সমস্ত থানা ও ডিভিশনগুলিকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দোকানগুলিতে বেআইনি ভাবে অ্যাসিড বিক্রি বন্ধ করতে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।’’

তবে বিচার-প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার কারণে বছরের পর বছর অভিযুক্তের সাজা না হওয়ায় এক সময়ে হতাশা গ্রাস করে আক্রান্তদের। ২০০১ সালে কন্যাসন্তান হওয়ার ‘অপরাধে’ স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকেরা ময়না প্রামাণিকের মুখে অ্যাসিড ছুড়লেও সেই মামলা আজও কোর্টে ঝুলছে। ২০১৪ সালে এক ব্যক্তির প্রথম পক্ষের স্ত্রী, দ্বিতীয় পক্ষ ঊষা নস্করের মুখে অ্যাসিড ছুড়লেও আজও বিচার বা ক্ষতিপূরণ— মেলেনি কোনওটাই। হামলার পরে প্রথম পক্ষের স্ত্রীর কাছে ফিরে গিয়েছেন স্বামীও। ‘‘অপরাধীর সাজা হচ্ছে, বেঁচে থাকতে এটা দেখে যেতে পারব তো?’’—পরিচিতদের প্রায়ই এ কথা বলেন হতাশ ঊষা।

রাজ্যে অ্যাসিড-মামলার সাম্প্রতিকতম এই রায় আক্রান্তদের হতাশাকেই আরও উস্কে দেবে বলে মত দিব্যালোকের। তাঁর কথায়, ‘‘আইনের ধারা যা-ই হোক, এই রায়ে মানুষের কাছে ভুল বার্তা পৌঁছবে। আক্রান্তের অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে দিল যে অভিযুক্ত, তার এমন লঘু দণ্ডে লড়াই করার শক্তিটাই হারাবেন ওঁরা।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Acid Attack Verdict Crime against Women
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE