লড়াই: ‘ছপাক’ ছবির দৃশ্য, যেখানে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে প্রত্যাখ্যাত হচ্ছেন অ্যাসিড-আক্রান্ত নায়িকা।
দুই ছেলেকে মানুষ করতে শার্ট তৈরির কারখানায় কাজ নিতে হয়েছিল সোদপুরের সুনীতি কর্মকারকে। কয়েক মাসের মধ্যেই তাঁকে শুনতে হয়, ‘‘আর আসবেন না। অনেকেই আপনাকে মেনে নিতে পারছেন না।’’ অর্থাভাবে নিজের চিকিৎসাটুকুও করাতে না-পারা সুনীতি এর পরে ঢুকেছিলেন একটি আয়া সেন্টারে। কিছু দিন পরে সেখানেও শুনতে হয়, ‘‘আপনার মুখের জন্য অনেকেই আপনাকে নিতে চাইছেন না।’’ ২০১১ সালে অ্যাসিড-হামলার শিকার হওয়া, বছর বত্রিশের সুনীতির এখন দিন চলে দুই কিশোর ছেলের অল্প রোজগারে। অ্যাসিডের ক্ষত নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়েও ছেলেদের পড়াতে না পারার কষ্টটাই কুরে কুরে খায় তাঁকে।
জীবনভর হেঁশেল ঠেলতে রাজি ছিলেন না মনীষা পৈলান। কম্পিউটার বা বিউটিশিয়ানের কোর্স করে চেয়েছিলেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে। ২০১৫ সালে অবশ্য বদলে যায় জীবনটা। ‘‘অ্যাসিডে একটি চোখ নষ্ট হয়ে গিয়েছে আমার। অন্য চোখেও কম দেখি। হাতের কাজ, মেক-আপ বা কম্পিউটারের কাজের মতো কিছুই করতে পারি না এখন। আগে যা যা শিখেছিলাম, তার কোনওটাই আর সম্ভব নয়’’— হতাশ শোনায় মনীষার গলা।
‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরো’ (এনসিআরবি)-র রিপোর্ট বলছে, ২০১৮ সালে অ্যাসিড-হামলার সংখ্যার নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ ছিল দেশের মধ্যে প্রথম। এই অ্যাসিড-আক্রান্তেরা সরকারি তরফে ক্ষতিপূরণের টাকা পেলেও তার প্রায় পুরোটাই খরচ হয়ে যাচ্ছে শুধু চিকিৎসায়। কিন্তু তার পরে? আক্রান্তদের পুনর্বাসনের কোনও প্রকল্প না থাকায় বাকি জীবনটা কাটছে চূড়ান্ত অসহায়তা ও নিরাপত্তাহীনতায়।
‘ছপাক’ ছবিতে দীপিকা পাড়ুকোন ওরফে অ্যাসিড-আক্রান্ত মালতীকে চাকরি চেয়ে শুনতে হয়েছে, ‘বিউটি পার্লার চালাতে গেলে কিছু বিউটির প্রয়োজন।’ সেই তথাকথিত ‘বিউটি’র দোহাই দিয়ে বাস্তবেও কাজ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন অ্যাসিড-আক্রান্তেরা। মনীষা-সুনীতিরা বলছেন, ‘‘এই মুখের জন্যই কাজ পাই না। কোনও বেসরকারি সংস্থা নিচ্ছে না। সরকারি চাকরি পাওয়া তো সোজা নয়। অনেকের চোখও নষ্ট হয়ে গিয়েছে। দিনের পর দিন এ ভাবে চলতে চলতে মনের জোরটাই কমে আসছে আমাদের।’’ তাঁরা জানান, ভবিষ্যতের কথা ভেবে হামলাকারী স্বামীকে ক্ষমা করে দেওয়ার কথাও ভাবছেন অনেকে। ভাবছেন, সেই স্বামীর কাছে ফেরার কথাও। তাই শুধু ক্ষতিপূরণের টাকা আর সহানুভূতি নয়, পুনর্বাসনের দাবিও তুলছেন তাঁরা।
একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদ্যোগে কয়েক বছর আগে আগরায় তৈরি হয়েছে অ্যাসিড-আক্রান্তদের পরিচালিত কাফে। উত্তরাখণ্ড সরকারও সম্প্রতি তাঁদের জন্য ভাতা ঘোষণা করেছেন। সেই প্রসঙ্গ তুলে মনীষা বলছেন, ‘‘পড়াশোনা জানা মেয়েদের জন্য কর্মসংস্থান, আর যাঁরা দেখতে পান না, তাঁদের জন্য অন্তত ভাতার ব্যবস্থা করুক সরকার। বেসরকারি ক্ষেত্রেও প্রশিক্ষণ পেলে এই মেয়েরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে চাকরি করতে পারেন। সহানুভূতি নয়, বাকি জীবনটা মাথা উঁচু করে বাঁচতে চাই আমরা।’’ অ্যাসিড-আক্রান্তদের নিয়ে কাজ করা একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের তরফে দিব্যালোক রায়চৌধুরী জানাচ্ছেন, পুনর্বাসনের প্রশ্নে সরকারি তরফে তৎপরতা এখনও সে ভাবে নেই। তবে নিজেদের সংগঠন ও কয়েকটি বেসরকারি জায়গায় কয়েক জনকে কাজের সুযোগ করে দিয়েছেন তাঁরা। দিব্যালোকের কথায়, ‘‘এই মেয়েদের অনেকেরই কিছু শারীরিক প্রতিবন্ধকতা আছে, ফলে সব কাজ ওঁরা করতে পারছেন না। সেই কারণেও পিছিয়ে পড়ছেন ওঁরা।’’
অ্যাসিড-হামলায় আরও কড়া সাজার পক্ষে সওয়াল করা রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন লীনা গঙ্গোপাধ্যায় পুনর্বাসনের প্রশ্নে বলছেন, ‘‘ক্ষতিপূরণটা যাতে ঠিকঠাক পায়, সেটাই আপাতত আমাদের প্রথম লক্ষ্য।’’ রাজ্যের নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রী শশী পাঁজা বলছেন, ‘‘অ্যাসিড-আক্রান্তদের ক্ষতিপূরণ ও আইনি দিকটা স্বরাষ্ট্র দফতর দেখে। তবে ভাতাটাই এই সমস্যার সমাধান নয়। সমাজের আর পাঁচ জন পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য যে সমস্ত সরকারি প্রকল্প রয়েছে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে সেখানেই প্রশিক্ষণ নিতে পারেন এই মেয়েরাও।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy