Advertisement
E-Paper

স্মৃতি আঁকড়েও বদলাচ্ছে ‘রাজার রাস্তা’

আমার পাড়া বলতে রাজা নবকৃষ্ণ স্ট্রিট। অবশ্য সবটা নয়, পুবে লাহা কলোনির মাঠ থেকে পশ্চিমে যতীন্দ্রমোহন অ্যাভিনিউ-লাল মন্দির। উত্তর কলকাতা তথা সারা কলকাতার সবচেয়ে পুরনো পাড়া।

অলককৃষ্ণ দেব

শেষ আপডেট: ০৪ জুলাই ২০১৫ ০০:৩৪

আমার পাড়া বলতে রাজা নবকৃষ্ণ স্ট্রিট। অবশ্য সবটা নয়, পুবে লাহা কলোনির মাঠ থেকে পশ্চিমে যতীন্দ্রমোহন অ্যাভিনিউ-লাল মন্দির। উত্তর কলকাতা তথা সারা কলকাতার সবচেয়ে পুরনো পাড়া।

লোকে আগে বলত ‘রাজার রাস্তা’। আড়াইশো বছরেরও আগে রাজা নবকৃষ্ণ দেব ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছ থেকে সুতানুটি অঞ্চল কয়েকটি গ্রামের বিনিময়ে কিনে নেন। তখন থেকেই এই রাস্তায় জনবসতি শুরু হয়। আমরা রাজা নবকৃষ্ণ দেবের বংশধরেরা সেই তখন থেকেই রাজা নবকৃষ্ণ স্ট্রিটের দু’ধারে বসবাস করছি।

স্বাধীতার পর থেকেই কিন্তু পাঁচমিশেলি জনতা এসে থাকতে শুরু করেছে। পুরনো বাসিন্দারা সরে গিয়ে নতুন ভাড়াটিয়ারা বসেছেন। অ-বাংলাভাষী, ও-পার বাংলার মানুষ— সক্কলে আছেন। এখনও মোহনবাগান জিতলে পাড়ায় প্রকাণ্ড সবুজ-মেরুন পতাকা উড়তে দেখলে বুকটা ভরে যায়। তবে ই্স্টবেঙ্গল জিতলেও পাড়ায় ইদানীং বারান্দায় লাল-হলুদ পতাকা বেঁধে উল্লাস দেখি। তবে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল পাশাপাশি থাকলেও কোনও মারামারি-কাটাকাটি নেই।

অনেকটা একই ভাবে পাড়ার রাজনৈতিক চরিত্রেও তো বদল দেখছি। আগে এখানে সিপিএমের প্রভাব বেশি ছিল। প্রয়াত কাউন্সিলর পূর্ণেন্দু সেনগুপ্ত ছিলেন ভারী সজ্জন মানুষ। ওঁর স্ত্রী করুণা সেনগুপ্ত এখন কাউন্সিলর। এ পাড়াতেই রাজ্যের মন্ত্রী শশী পাঁজা ফি-হপ্তায় অফিস করেন, লোকজনের কথা শোনেন। ভারী ভাল মেয়ে! আমাদের মতো প্রবীণদের সঙ্গে ‘কাকু’ বলে কথা বলেন!

সব রাজনৈতিক দল বেশ মিলেমিশেই এখানে থাকে। কোনও অশান্তি নেই। পাড়ার জঞ্জাল পরিষ্কারের কাজও বেশ নিয়মিত হয়।

জয়পুরিয়া কলেজে কো-এডুকেশন এ পাড়ার একটা বড় বদল। দল বেঁধে ছেলেমেয়েদের এক সঙ্গে কলেজ যেতে দেখি। কী সব গোলমাল উপলক্ষে পুলিশের গাড়িও দেখি এ তল্লাটে ঢুকছে। তবু একটা তারুণ্যের উত্তাপ— সব সময়ে এ পাড়াকে ঘিরে রাখে।

ছাদগুলো জোড়া থাকায় আমাদের ঘুড়ি ওড়াতে আর ধরতে খুবই সুবিধা হত। এখন প্রোমোটারির কল্যাণে সেই বাড়ির পুরনো চেহারা পাল্টে গিয়েছে। নতুন ফ্ল্যাট উঠছে। ছাদগুলোর মধ্যে ফাঁক-ফাঁক। তবে প্রায় চার-কুড়ি বয়সেও আমাদের বাড়ির ছাদ থেকে আমি এখনও ধুতি গুটিয়ে তরতরিয়ে পাশের ছাদে উঠে যাই। সটান আমাদের ঠাকুরবাড়ির ছাদে গিয়ে ল্যান্ড করি।

দক্ষিণ ফুটে রাস্তার উপরে আমাদের প্রায় সব বাড়িতেই তখন রকও ছিল। রকে বসে আড্ডাই পাড়াটার প্রাণ। বয়স অনুযায়ী, কারা কখন আড্ডা দেবে ঠিক করা থাকত। এখন সেই সব রক ভাঙছে। বাড়ির নীচে দোকান। এ পাড়াটায় এখন সাইবার কাফে, প্যাথলজিক্যাল সেন্টার, বিউটি পার্লার, ফাস্ট ফুড সেন্টার— কী নেই! তবে পুরনো ফেরিওয়ালাদের কথা ভেবে মনটা খারাপ হয়। ‘মালাই ব-রৌ-ফ’ বলে ডাকটা তাও শুনতে পাই। কিন্তু টিনের বাক্সধারী ঘুগনিওয়ালা, প্যাটিসওয়ালা, মিষ্টিওয়ালা বা কাচের বাক্স বোঝাই শোনপাপড়িওয়ালারা? এক ধরনের চিংড়ির কাটলেট খেতে দেখলে ব়ড়রা বকতেন! বলতেন, খাস্‌নে, ‘নেংটি ইঁদুরের কাটলেট’! আমাদের পাল্লায় পড়লে এই সব খাবারের পুরো বাক্স উজাড় হয়ে যেত।

গুণিজনের কখনওই অভাব নেই এ পাড়ায়। প্রয়াত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী শিপ্রা বসু এ পাড়ারই মেয়ে। বাঘ-ওয়ালা বাড়িতে ছেলেবেলায় খেলাধুলো করেছেন। নক্ষত্র নাট্যগোষ্ঠীর শ্যামল ঘোষ, নীলিমা ঘোষদের রিহার্সালে পাড়া মেতে থাকত। লেখক বিশু মুখোপাধ্যায়ের কথাও খুব মনে পড়ে।

পরিবেশন, আপ্যায়ন, সৎকারের মতো কাজেও পাড়াতেই আমাদের হাতেখড়ি। বাড়ি-বাড়ি প্রায়ই রান্না করা তরিতরকারি বিনিময় হত। আমরা ছোটরা ‘বাহকে’র ভূমিকায়। সুখে-দুঃখে ভাল-মন্দে সবাই সবার জন্য ব্যস্ত হত।

নানা নতুনের স্বাদেও সেই পুরনো পাড়াটাকে এখনও খুঁজি আমি। ৫০-৬০ বছর আগে পর্যন্ত এই রাস্তায় দুর্গাপুজো উপলক্ষে মেলা বসত। কলকাতার আদি যুগের মেলা। সেই মেলা হারিয়ে গিয়েছে। সেই চাপা কল, গ্যাসবাতি, ফেরিওয়ালারাই বা কোথায় গেল ?

আমাদের অত প্রিয় নাটমন্দিরটায় এখন কর্পোরেশনের সুতানুটি ‘কমিউনিটি হল’ হয়েছে। ওখানেই বড়দের লুকিয়ে আমাদের খুদেদের গোপন পিকনিক হত।

লাহা কলোনির মাঠটায় একটা খেলার মাঠ হয়েছে দেখে খুব আনন্দ হয়। ওখানে আগে রাজ্য সরকারের খাদ্য দফতরের গো়ডাউন ছিল। ও দিকে, একটা লেডিজ হস্টেলও রয়েছে। দূর মফস্‌সল থেকে দেখি মেয়েরা পড়তে বা চাকরি করতে আসছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানসিকতার এই বদল দেখতে ভালই লাগে!

তবে এই ডট কমের যুগে আমাদের সেকেলে খেলাধুলো, দল বেঁধে আনন্দ আর দেখা যায় না। তবে আমি চেষ্টা করি পুরনো ঐতিহ্য ধরে রাখতে। আমাদের ঠাকুরবাড়িটিকে আমি মিলনমেলা কেন্দ্র বলি। নানা রকম উৎসব, পুজো, খেলাধুলো, গানবাজনা, নাটক প্রভৃতির আয়োজনে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা উৎসাহ ও আনন্দের সঙ্গে অংশগ্রহণ করে। এ ভাবেই নতুনের সঙ্গে সমঝোতা করে কিছুটা পুরনো ঐতিহ্য ধরা রয়েছে।

লেখক শোভাবাজার রাজ পরিবারের সদস্য

Alak Krishna Deb Raja Naba krishna street red yello jaipuria college
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy