‘মাস্টারমশাই, আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি।’
নির্বাচন কমিশনের সৌজন্যে তপন সিংহের বিখ্যাত সিনেমা ‘আতঙ্ক’-র সংলাপ বদলে এখন—‘মাস্টারমশাই, আপনি একটু দেখে দিন।’’
ভোটের সময় আমি কোনও ‘দুষ্টুমি’ করব না। ‘লক্ষ্মী ছেলে’ হয়ে থাকব, নির্বাচন কমিশনের কাছে এমনই মুচলেকা দিতে হচ্ছে অভিযুক্তদের। সঙ্গে দিতে হচ্ছে স্কুলের প্রধান শিক্ষক, জীবন বিমা নিগমের প্রবন্ধক বা ম্যাজিস্ট্রেটের মতো সমাজের দু’জন প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তির শংসাপত্র। ভোটের আগে এমন ‘বন্ড’ জমা দিতে গিয়ে শংসাপত্র নেওয়ার জন্যই এখন ‘দর বাড়ছে’ মাস্টারমশাইদের। প্রতিষ্ঠিত মানুষদের তালিকার মধ্যে মাস্টারমশাইদের নাগাল পাওয়াই সবচেয়ে সহজ। কারণ, নিদেনপক্ষে ক্লাস ‘সেভেন-এইট’ পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে অনেক অভিযুক্তই। ফলে ছুটকো অপরাধী থেকে দাগি অপরাধীরা ভিড় করছেন এক সময়ের মাস্টারমশাইয়ের কাছে। টুক করে প্রণাম সেরেই ‘আব্দার’, ‘স্যর, আমিও তো আপনার ছাত্র। একটু দেখে দিন।’’
যেমন দত্তপুকুর থানার দিঘার বাসিন্দা, তোলাবাজিতে অভিযুক্ত এক অভিযুক্ত ‘দুষ্টুমি’ না করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে উত্তর ২৪ পরগনা জেলা প্রশাসনের কাছে মুচলেকা জমা দিয়েছেন। সঙ্গে জীবন বিমা নিগমের এক শাখা প্রবন্ধক আর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের শংসাপত্র। কেন দিলেন? বিব্রত ‘মাস্টারমশাইয়ের’ কথায়, ‘‘ছেলেটি এমনিতে ভাল। এসে ধরল তাই...।’’ তবে ওই এলাকারই কদম্বগাছির বাসিন্দা ডাকাতিতে অভিযুক্ত আর এক ব্যক্তি রেহাই পাননি। এক হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের শংসাপত্র দিতে পারলেও অন্য শংসাপত্রটি জোগাড় করতে পারেননি তিনি। ফলে জামিন হয়নি।
অশান্তি এড়াতে আগেভাগেই কিছু সতর্কতা নেয় নির্বাচন কমিশন। তার অঙ্গ হিসেবে একটি এলাকায় কত আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে তার হিসেব, বেআইনি মদ আটক করা হয়। পাশাপাশি গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকা সত্ত্বেও যাদের ধরা যায়নি, তাদের জামিন নেওয়া বা ধরা, ধরতে না পারলে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশও দেয় আদালত। উত্তর ২৪ পরগনার দুই কমিশনারেট (বিধাননগর, ব্যারাকপুর) এবং জেলা পুলিশকে নিয়ে ডিসেম্বর থেকে সাড়ে তিন হাজার ‘হুলিয়া’ থাকলেও ভোটের আগে নির্বাচন কমিশনের তৎপরতায় এখন তা এক হাজারে পৌঁছেছে।
এ ছাড়াও রয়েছে, ভারতীয় দণ্ডবিধির ১১০ ধারা। সেই ধারায় ইতিমধ্যেই আটক করা হয়েছে ১৩০ জন দাগি আসামীকে। পুলিশ জানায়, থানায় রাখা থাকে ওই অপরাধীদের ‘হিস্ট্রি শিট’। ব্রিটিশ আমলে যেমন ‘ভিলেজ ক্রাইম নোটবুক’ থাকত তেমনই। পুলিশ জানায়, বসিরহাটের এক অভিযুক্ত ভোটের আগে খুনের ঘটনায় জামিন পায়। কিন্তু ১১০ ধারার সুযোগ নিয়েই তাকে আটকে দেওয়া হয়। বন্ডের শর্তে এক জন গেজেটেড অফিসার, জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের শংসাপত্র দাবি করা হয়। তাতেই আটকে যায় জামিন। পুলিশ সুপার তন্ময় রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘অভিযুক্তদের অপরাধের মাত্রা বিচার করেই বন্ডে কারা শংসাপত্র দেবেন সেই শর্ত দেওয়া হচ্ছে।’’
পাশাপাশি রয়েছে আইনের ১০৭ ধারা। ছুটকো অপরাধী বা কোনও না কোনও ঘটনায় অভিযুক্ত, অথবা জামিন পেয়েছে এমন অপরাধীদের ক্ষেত্রে আগাম সতর্কতার জন্য প্রয়োগ হচ্ছে এই ধারা। সেই ধারার জন্য মহকুমা শাসকের কাছ থেকে নিতে হচ্ছে মুচলেকার বন্ড। ইতিমধ্যে সাড়ে ৫ হাজার এমন বন্ড ছাড়া হয়েছে গোটা জেলায়। থানা থেকে নির্দেশ যাওয়ার পরে সংশ্নিষ্ট মহকুমা শাসকের কাছ থেকে সেই বন্ড নিতে হচ্ছে। সেই বন্ড নিয়েই শংসাপত্রের জন্য মাস্টারমশাইয়ের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে অভিযুক্তদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy