E-Paper

ধর্ষণের প্রতিবাদে ‘ধর্ষণেরই হুমকি’ সমাজমাধ্যমে!

সমাজমাধ্যমে কোনও মহিলার সঙ্গে অভিযুক্তের ছবি দেখলেই তাতে লেখা হচ্ছে, ‘ধর্ষণে প্রশ্রয় কি তোমরাই দিয়েছ?’ কিংবা, ‘তোমরাও কি ধর্ষণের শিকার হয়েই ওর সঙ্গে মিশছিলে?’

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ৩০ জুন ২০২৫ ০৭:১০
ব্যক্তিগত ছবি বিকৃত করে সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকিও রয়েছে নানা পোস্টে।

ব্যক্তিগত ছবি বিকৃত করে সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকিও রয়েছে নানা পোস্টে। —প্রতীকী চিত্র।

কখনও খুন করার হুমকি দেওয়া হচ্ছে, কখনও সরাসরি বাড়িতে ঢুকে ধর্ষণ করার কথা বলা হচ্ছে। সপরিবার বাড়িছাড়া করার বা ব্যক্তিগত ছবি বিকৃত করে সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকিও রয়েছে নানা পোস্টে। দক্ষিণ কলকাতা ল কলেজে ছাত্রীকে গণধর্ষণের ঘটনায় ধৃত, মূল অভিযুক্তের সঙ্গে যে মহিলারই ছবি সমাজমাধ্যমে রয়েছে, তাঁকেই এই মুহূর্তে নিশানা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ। ছবি ছড়িয়ে ঘৃণাভাষ্যে সব থেকে বেশি বিদ্ধ অভিযুক্তের এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। লাগাতার আক্রমণের মুখে তাঁদের অনেকেই সমাজমাধ্যমে অ্যাকাউন্ট মুছে দিয়েছেন। কেউ কেউ পুলিশের দ্বারস্থ হওয়ার কথাও ভাবছেন।

আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসক-পড়ুয়াকে খুন ও ধর্ষণের ঘটনা সামনে আসার পরে দেদার ছড়িয়েছিল নিহত ডাক্তার-ছাত্রীর নাম, ঠিকানা ও ছবি। মৃতদেহ উদ্ধারের সময়ের ছবিও বাদ যায়নি। সেই সঙ্গে ঘটনাটি নিয়ে যা খুশি লেখা চলছিল সমাজমাধ্যমে। যেমন কেউ লেখেন, ঘটনাস্থল থেকে ১৫০ গ্রাম বীর্য পাওয়ার কথা। কেউ লেখেন, নির্যাতনে তরুণীর ‘পেলভিক বোন’, ‘কলার বোন’ ভাঙার বিবরণ। এ-ও লেখা হয়েছিল, ‘খুন এবং ধর্ষণের সময়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত আর এক মহিলাই ওই চিকিৎসক-পড়ুয়ার দু’হাত চেপে ধরেছিল। অন্যেরা দু’পা দু’দিকে টেনে ধরে চিরে দিয়েছে!’

বাস্তবে অবশ্য দেখা গিয়েছে, সমাজমাধ্যমের ওই সব দাবির বেশির ভাগই ভুয়ো। মনোরোগ চিকিৎসক থেকে আইনজীবীদের বড় অংশই বলছেন, ‘‘ভুয়ো তথ্যের বিস্ফোরণ ঘটেছিল ওই সময়ে। মিথ্যাচারের এই বহরে সমাজে আরও আতঙ্ক বাড়ে। কিন্তু শুধুমাত্র অভিযুক্তের পরিচিত বলে মহিলাদের এমন হুমকি আরও মারাত্মক।’’

দেখা যাচ্ছে, সমাজমাধ্যমে কোনও মহিলার সঙ্গে অভিযুক্তের ছবি দেখলেই তাতে লেখা হচ্ছে, ‘ধর্ষণে প্রশ্রয় কি তোমরাই দিয়েছ?’ কিংবা, ‘তোমরাও কি ধর্ষণের শিকার হয়েই ওর সঙ্গে মিশছিলে?’ মহিলাদের প্রোফাইল ধরে ধরে তাঁদের সঙ্গে মনোজিতের ছবি ‘শেয়ার’ করার ঢালাও আবেদন জানানো চলছে। কসবার কলেজের প্রভাবশালী ওই প্রাক্তনীর এক বান্ধবীর ছবির নীচে লেখা, ‘আপনার থেকে ওর নিশ্চয়ই সব পাওয়া হয়ে গিয়েছিল। আপনি কিছুই জানতেন না?’

মনোরোগ চিকিৎসক রিমা মুখোপাধ্যায় বললেন, ‘‘অত্যন্ত ঘৃণ্য ব্যাপার। ধর্ষণের শিকার একটি মেয়ের জন্য প্রতিবাদ করার নামে অন্য মহিলাদের ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হচ্ছে? এ আদতে সমাজের একটি অংশের ধর্ষক মনোবৃত্তিই ফুটিয়ে তোলে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘দেখছি, ছেলেটির প্রেমিকার উদ্দেশ্যে লেখা, তিনিও হয়তো ‘কম্প্রোমাইজ়’ করেছেন। তিনি শোধরাতে পারেননি, তাই ছেলেটি নাকি এমন কাণ্ড ঘটিয়েছে। এ তো একেবারেই পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, যা সমাজের সব অপরাধের দায় মেয়েদের ঘাড়ে চাপায়। এ যেন ছোট বাচ্চা পড়ে গেলে মেঝেকে দোষ দেওয়ার মতো! রাজনৈতিক নেতারাও নির্যাতিতা তরুণী কেন ওখানে গিয়েছিলেন, না গেলে এমনটা হত না, গোছের মন্তব্য করছেন।’’

এর মধ্যেই কয়েকটি ভিডিয়ো ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সমাজমাধ্যমে। যা বান্ধবীদের সঙ্গে কাটানো অভিযুক্তের ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের বলে দাবি করা হচ্ছে। সাইবার অপরাধ সংক্রান্ত বিষয়ের আইনজীবী বিভাস চট্টোপাধ্যায় বললেন, ‘‘এ তো দণ্ডনীয় অপরাধ। পুলিশ চাইলে অভিযোগের জন্য অপেক্ষা না-করে নিজেরা ধরে ধরে নোটিস পাঠাতে পারে। ভারতীয় ন্যায় সংহিতার পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তি আইনেও জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা হতে পারে। যুক্ত করা যেতে পারে অন্যের সম্পর্কে মানহানিকর মন্তব্য করা, মহিলাদের সম্ভ্রমহানির অভিপ্রায় এবং অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের ধারাও।’’ এর পরে তাঁর মন্তব্য, ‘‘ঘটনাচক্রে আমি দক্ষিণ কলকাতা ল কলেজ থেকেই পাশ করেছি। যাঁরা এমন ভিডিয়ো ছড়াচ্ছেন, তাঁদের অভিপ্রায় কি ধর্ষকের থেকে আলাদা বলা যায়?’’ মনোরোগ চিকিৎসক দেবাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘‘তীব্র রাগ বা ক্ষোভ উগরে দিতে গিয়ে অভিযুক্তের সঙ্গীকেও ছাড়া হচ্ছে না। তাঁদের সামাজিক সম্মান বেআব্রু করার চেষ্টা চলছে। যিনি এমনটা করছেন এবং যাঁর উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে, এই পরিস্থিতি দু’জনের জন্যই সমান ক্ষতিকর।’’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Social Media Kasba Rape Case

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy