Advertisement
E-Paper

নাগরিকত্বের কাঁটা উৎসবের অ্যাংলো পাড়ায়

‘‘এই দেশে চিরকাল সব ধর্মের মানুষ পাশাপাশি থেকেছে। আজ হঠাৎ করে সরকার নিজের স্বার্থে ব্রিটিশদের বিভাজন নীতি অনুসরণ করছে। সেটা কখনও মেনে নেওয়া যায়?’’

স্বাতী মল্লিক

শেষ আপডেট: ২৩ ডিসেম্বর ২০১৯ ০১:৪৮
ঝলমলে: সেজে উঠেছে বো ব্যারাক। রবিবার। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

ঝলমলে: সেজে উঠেছে বো ব্যারাক। রবিবার। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

তাঁদের ঘরে ঘরে এখন শেষ মুহূর্তের চূড়ান্ত ব্যস্ততা। কেক, মোমো, ওয়াইন তৈরির মাঝে কথা বলা তো দূর, দম ফেলারও ফুরসত নেই। লাল দেওয়ালের পুরনো পাড়ায় কোথাও পড়ছে নতুন রং, কোথাও চলছে আলোর মালা দিয়ে সাজানোর কাজ। তবু বড়দিনের আগে উৎসবমুখর বো ব্যারাকের মনে কাঁটা হয়ে বিঁধছে এনআরসি এবং নয়া নাগরিকত্ব আইন।

‘‘আমাদের কাছে তো সব নথি রয়েছে। আধার-ভোটার কার্ড, প্যান কার্ড— সব। তা হলে কি করে আমরা এ দেশের নাগরিক না-ও হতে পারি?’’— ব্যস্ত হাতে চিকেন ডাম্পলিং বানাতে বানাতে প্রশ্নটা ছুড়ে দিলেন অ্যাংলো পাড়ার বাসিন্দা ডিওন আলেকজ়ান্ডার। প্রশ্ন শুনে দাঁড়িয়ে গেলেন পথচলতি এক অ্যাংলো মহিলা। বললেন, ‘‘এই দেশে চিরকাল সব ধর্মের মানুষ পাশাপাশি থেকেছে। আজ হঠাৎ করে সরকার নিজের স্বার্থে ব্রিটিশদের বিভাজন নীতি অনুসরণ করছে। সেটা কখনও মেনে নেওয়া যায়?’’

সম্প্রতি লোকসভা ও কিছু বিধানসভায় অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের সংরক্ষণ তুলে দেওয়া নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে বো ব্যারাকের বাসিন্দাদের মধ্যে। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, সারা দেশে অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২৯৬ জনে। যদিও শহরের অ্যাংলো পাড়ার মত, লোকসভায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদের দেওয়া ওই পরিসংখ্যানের সঙ্গে বাস্তবের বিস্তর ফারাক। এখন এর সঙ্গে বাড়তি মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে নয়া নাগরিকত্ব আইন। বর্তমানে বিজেপি সরকারের নিশানায় মুসলিমরা থাকলেও দেশের বাকি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যে নিরাপদে নেই, বিলক্ষণ বুঝেছেন তাঁরা। তাই সকলকে এককাট্টা হয়েই প্রতিবাদ করতে হবে বলে জানাচ্ছেন স্কুলশিক্ষিকা সাশা সিডলিং। অ্যাংলো পাড়ার তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি সাশার সাফ কথা, ‘‘আমরা এ দেশেরই। কিন্তু অন্য কেউ এসে কেন সেটা ঠিক করে দেবে?’’ ‘বো ব্যারাক রেসিডেন্টস ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’-এর সহ-সভাপতি মাইকেল চ্যাং বলছেন, ‘‘তরুণ প্রজন্মের কাছে সব রকম পরিচয়পত্র রয়েছে। কিন্তু বাপ-ঠাকুরদার আমলের কোনও কাগজ তো কারও কাছেই নেই! আমাদের বেশির ভাগ লোকেরই নিজস্ব জমি, বাড়িঘর নেই। তা হলে তার দলিল পাব কোথায়? আমার কাছে পুরনো নথি বলতে ১৯৪২ সালে ঠাকুরদার বাড়ি ভাড়া দেওয়ার রসিদ। সেটাই পরিবারের সম্বল।’’

দুশ্চিন্তা কুরে কুরে খাচ্ছে জেবা পরভিনকেও। জেবার বাবা মুসলিম, মা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। বো ব্যারাকের উৎসবের আবহে ঘরোয়া আড্ডার মাঝেও মুখটা খানিক শুকনো লাগে তাঁর। বলেন, ‘‘ওরা হিন্দু রাষ্ট্র বানাতে চায়। আমরাও যে এ দেশেরই মানুষ, সেই অধিকারটুকু কেড়ে নিতে চায়। আশা করি দেশের বাকি মানুষ এই অধিকারের লড়াইয়ে আমাদের পাশে থাকবেন।’’

অধিকার বুঝে নিতেই যে কয়েক দিন ধরে পথে নামছে এ শহর, তার রেশ ছুঁয়ে গিয়েছে অ্যাংলো পাড়াকেও। নিউ মার্কেটে গিয়ে বা কর্মস্থল থেকে ফেরার পথে অনেকেই দেখেছেন প্রতিবাদী মিছিল। কেউ আবার ফোন খুলে দেখাচ্ছেন, স্কুলের বন্ধুদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ১৮ জনই মুসলিম, আর এক জন হিন্দু। সেখানেও জোর আলোচনা এই নিয়েই। ভিন্‌দেশি শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার বদলে এ দেশের মানুষের পরিচয় নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে সরকার, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই বো ব্যারাকের বাসিন্দাদের।

আপাতত অবশ্য প্রতিবাদী সুরকে পিছনে রেখে উৎসবে মন দিতে চাইছে শহরের অ্যাংলো মহল্লা। বড়দিনের আনন্দটুকু চেটেপুটে উপভোগ করে নিতে চান তাঁরা। তার পরে নামবেন পথে। মাইকেল বলছেন, ‘‘উৎসব শেষ হলে আমরাও প্রতিবাদে শামিল হব। নবীন-প্রবীণদের নিয়ে সেই মৌন মিছিল হবে বলে ঠিক হয়েছে। এই আইন আমরাও মুখ বুজে মেনে নেব না।’’

Bow Barrack Christmas CAA Anglo Indian
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy