ইজরায়েলি ‘উজি’ পিস্তল।
‘মুঙ্গেরি’র দাপটের কথা জানা গিয়েছে আগেই। এ বার ইঙ্গিত মিলছে মুঙ্গের-ইজরায়েল যুগলবন্দির।
যার ফল— বুধবার রাতে হরিদেবপুরের কবরডাঙায় কয়েক মিনিটে ৩৫ রাউন্ড গুলি!
ঘটনাস্থল থেকে মুঙ্গেরে তৈরি ৭.২ এমএম পিস্তলের অজস্র খোল পেয়েছিলেন গোয়েন্দারা। তাঁরা বলেছিলেন, কলকাতার অন্ধকার জগৎ ছেয়ে ফেলেছে এই পিস্তল। কিন্তু ওই ঘটনায় নিহত রাহুল মজুমদারের প্রাণ নিয়েছে যে বুলেট, সেটি সম্ভবত এই দেশি পিস্তলের নয়। অভিজ্ঞ পুলিশ অফিসারেরা প্রাথমিক ভাবে সন্দেহ করছেন, এই গুলি বেরিয়েছে ‘উজি’ মেশিন পিস্তল থেকে। স্বয়ংক্রিয় এই পিস্তল তৈরি হয় ইজরায়েলে। ভারতে তা সহজলভ্য নয়। আর যদি পাওয়াও যায়, দাম পড়ে প্রায় লাখ দেড়েক টাকা।
এক পুলিশ অফিসার বলছিলেন, ‘‘এমনটা হতেই পারে, বুধবার রাতে দুষ্কৃতীদের এক জন বিদেশি মেশিন পিস্তল থেকে গুলি চালাচ্ছিল। তার ছোড়া গুলিই লেগেছে রাহুলের।’’ এমন ভয়ঙ্কর পিস্তল কী করে কলকাতার ছিঁচকে মস্তানদের হাতে উঠে এল, সেটাই ভাবাচ্ছে গোয়েন্দাদের। এবং তাঁরা বলছেন, এর পরিণতি হতে পারে মারাত্মক। ‘সেমি-অটোম্যাটিক’ বা ‘ফুল-অটোম্যাটিক’— দু’ভাবেই ব্যবহার করা যায় এই পিস্তল। অর্থাৎ একটা-একটা করে গুলি ছোড়া যায়, আবার ট্রিগার একটানা টিপে রেখে ম্যাগাজিন খালিও করে দেওয়া যায়। এই ধরনের অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের মুখে সাধারণ পুলিশ অসহায় তো বটেই। তার উপর দু’দল দুষ্কৃতীর সংঘর্ষে যদি এ বার থেকে বিদেশি মেশিন পিস্তল চলতে থাকে, তা হলে এক সময়ের মুম্বইয়ের মতো কলকাতার বুকেও অন্ধকার জগতের রাজত্ব নেমে আসার বেশি দেরি নেই।
গোয়েন্দাদের অনেকের মনে পড়ছে ২০০৭-এর একটি ঘটনা। হরিদেবপুরের মতো সে বার গণ্ডগোলও হয়েছিল পানশালায়। মির্জা গালিব স্ট্রিটে ওই ঝামেলার সূত্রে গোয়েন্দারা বেলজিয়ামে তৈরি একটি ৯ এমএম পিস্তলের সন্ধান পেয়েছিলেন। ওই বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্রটি কী ভাবে শহরের দুষ্কৃতীদের কাছে পৌঁছল, ভেবে তখন বিস্মিত হয়েছিলেন পুলিশকর্তারা। পরে জানা যায়, চোরাপথে পিস্তলটি এসেছে পশ্চিম এশিয়ার কোনও দেশ থেকে। সে বার বেলজিয়াম, এ বার ইজরায়েল। পুলিশকর্তারা জানাচ্ছেন, নানা দেশের নিরাপত্তাবাহিনীর কাছে চাহিদা রয়েছে উজি পিস্তলের। তবে আশ্চর্য ব্যাপারটা হল, অ্যাকশন-ভিত্তিক কম্পিউটার গেমের দৌলতে এই পিস্তলের নাম এখন অনেক বাচ্চাও জানে।
হরিদেবপুরে নিহত রাহুলের ময়না-তদন্তকারী এক চিকিৎসকের কথায়, ওই যুবকের মাথার ডানদিকে গুলি লেগেছে বলে পুলিশ প্রাথমিক রিপোর্ট দিয়েছিল। লালবাজারের একাধিক কর্তার সামনে তাঁর দেহের ময়না-তদন্ত শুরু হয়। ময়না-তদন্তের ভিডিও রেকর্ডিংও করা হয়। কিন্তু মাথার এপাশ-ওপাশ তন্নতন্ন খুঁজেও কোনও ক্ষতচিহ্ন পাননি চিকিৎসকেরা। দেখা যায়, মৃত্যুর প্রায় ১৬ ঘণ্টা পরেও নিহতের নাকের পাশের একটি ক্ষত দিয়ে রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে। তখন নাকের ফুটো বরাবর কাঁটাছেঁড়া শুরু হয়। দেখা যায়, রাহুলের মাথার পিছনের একটি হাড়ের গায়ে চার সেন্টিমিটার লম্বা একটি পিতলের গুলি আটকে। গুলিটি রাহুলের বাঁ নাকের মধ্যে দিয়ে ঢুকে মাথার ভিতরের অনেকটাই চুরমার করে দিয়েছে। গুলির ওই ছিদ্রপথ ধরেই রক্তক্ষরণ হয়ে চলেছে। মাথার ভিতরের তছনছ অবস্থা এবং অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণেই ওই যুবকের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন ময়না-তদন্তকারীরা।
গুলিটি দেখেই লালবাজারের কর্তারা চমকে ওঠেন। তখন থেকেই ঘটনাস্থলে ‘উজি’র উপস্থিতি সন্দেহ করতে থাকেন তাঁরা। চিকিৎসকদের বক্তব্য, কমপক্ষে ৭ থেকে ১০ ফুট দূর থেকে ওই গুলি ছোড়া হয়েছিল। কারণ, ৩ থেকে ৪ ফুট দূরত্ব বা পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে কাউকে গুলি করা হলে ক্ষতের উপরে পোড়া দাগ থাকে। এ ক্ষেত্রে রাহুলের বাঁ নাকের ওই ক্ষতে পোড়া চিহ্ন ছিল না। পুলিশকর্তাদের ধারণা, ১০-১২ ফুট দূর থেকেই গুলিটি ছোড়া হয়েছে।
বিদেশি মেশিন পিস্তল সম্পর্কে আরও জানার জন্য ধৃত এক দুষ্কৃতীকে দফায় দফায় জেরা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তদন্তকারীরা। অন্য দুষ্কৃতীদের ব্যাপারেও খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। প্রাথমিক ভাবে পুলিশকর্তারা মনে করছেন, সীমান্ত পেরিয়ে চোরাপথেই ওই বিদেশি পিস্তল দুষ্কৃতীদের হাতে এসেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy