Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
জলে যখন আর্সেনিক

নলকূপ বন্ধ করে বাড়ি বাড়ি জল, আশ্বাস মেয়রের

মহানগরের মাটির তলায় আর্সেনিকের ভাণ্ডার যে রয়েছে, আগেই তা জানিয়েছিলেন ভূবিজ্ঞানীরা। শহরের নানা প্রান্তে গভীর নলকূপের জল থেকে সেই ‘বিষ’ যে মানুষের শরীরে ঢুকছে, তা-ও বলেছেন তাঁরা। এ বার সেই বিপদের কথা কার্যত মেনে নিলেন কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ও।

—ফাইল চিত্র।

—ফাইল চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০১৬ ০১:০৫
Share: Save:

মহানগরের মাটির তলায় আর্সেনিকের ভাণ্ডার যে রয়েছে, আগেই তা জানিয়েছিলেন ভূবিজ্ঞানীরা। শহরের নানা প্রান্তে গভীর নলকূপের জল থেকে সেই ‘বিষ’ যে মানুষের শরীরে ঢুকছে, তা-ও বলেছেন তাঁরা। এ বার সেই বিপদের কথা কার্যত মেনে নিলেন কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ও। শনিবার বণিকসভা ‘কনফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রিজ’ (সিআইআই)-এর এক অনুষ্ঠানে তাঁর প্রতিশ্রুতি, আগামী দু’-তিন বছরের মধ্যে কলকাতাকে নলকূপমুক্ত করে তুলবেন তিনি। তার বদলে বাড়ি বা়ড়ি গঙ্গার পরিশোধিত জল পৌঁছে দেবে পুরসভা। দিনের ২৪ ঘণ্টাই সেই পরিশোধিত পানীয় জল মিলবে। কলকাতা পুরসভার পানীয় জল প্রকল্পের এই কাজ ধাপে ধাপে চালু করা হবে বলেও মেয়র জানান।

১৯৮২ সালে এ রাজ্যে প্রথম আর্সেনিক দূষণের কথা জানা যায়। ২০০৬ সালে প্রকাশিত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, এ রাজ্যে কলকাতা-সহ ৯টি জেলার অন্তত ১১১টি ব্লক আর্সেনিকের কবলে পড়েছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজ এবং যাদবপুরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব কাল্টিভেশন অব সায়েন্সেস-এর সমীক্ষকেরা বিভিন্ন সময়ে সমীক্ষা করে দেখেছেন যে, ১০০টি ওয়ার্ডের ভূস্তরই আর্সেনিক-কবলিত। তার মধ্যে অন্তত ৪০টিতে আর্সেনিক দূষণ রয়েছে বিপজ্জনক মাত্রার থেকেও বেশি পরিমাণে।

কলকাতার আশপাশের রাজারহাট, নিউ টাউন, তেঘরিয়া, সোনারপুর, বারুইপুর, বিষ্ণুপুর এলাকাও আর্সেনিক প্রভাবিত। তাই কলকাতায় অবিলম্বে গভীর নলকূপের ব্যবহার কমিয়ে শহরবাসীকে আর্সেনিক-দূষিত জল খাওয়া থেকে বিরত রাখতে বিশেষজ্ঞেরা গত ২০ বছর ধরে সুপারিশ করে আসছেন। কিন্তু মহানগরীতে আর্সেনিকের দূষণ তেমন গুরুতর কিছু নয়, এই যুক্তিতে কলকাতা পুর-কর্তৃপক্ষ বারংবার সমস্যাটি এড়িয়ে গিয়েছেন। তাঁরা সমাধানের পথও খোঁজেননি।

বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, আলিপুর, ভবানীপুর, কালীঘাট, লেক গার্ডেন্স, ধর্মতলা, ময়দান, টালিগঞ্জ, যাদবপুর, বাঁশদ্রোণী এলাকার ভূগর্ভস্থ পানীয় জলে বিপজ্জনক মাত্রায় আর্সেনিক রয়েছে। এ ছাড়া, বেহালা এবং ইএম বাইপাস লাগোয়া এলাকাও আর্সেনিক প্রভাবিত। পরিবেশবিদদের অনেকেই বলছেন, কলকাতা ও লাগোয়া এলাকার জনসংখ্যা হুহু করে বেড়েছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ভূগর্ভ থেকে জল তোলাও। তার ফলেই আর্সেনিকের সমস্যা আরও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। কলকাতার তলায় আর্সেনিকের এমন বাড়াবাড়ি কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা ‘কেন্দ্রীয় ভূজল পর্ষদ’ও বারবার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। কিন্তু দক্ষিণ কলকাতা ও বাইপাসের দুই ধারের আবাসনগুলিতে গভীর নলকূপ বসানো বন্ধ হয়নি। ফলে কলকাতার ভূগর্ভস্থ জলস্তর নামছে খুব দ্রুত হারে। তাতেই বাড়ছে আর্সেনিকের কামড়।

পরিবেশবিদ ও জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরা বারবারই জানিয়েছিলেন, আর্সেনিক-দূষিত পানীয় জলের হাত থেকে মানুষকে বাঁচাতে হলে নদীর জল শোধন করে বাড়ি বা়ড়ি সরবরাহ করতে হবে। কিন্তু পুরসভা সে ব্যাপারে আমল দিতে চায়নি। বরং বারবার গভীর নলকূপেই ভরসা রেখেছে তারা। পুরসভা সূত্রের খবর, এ বছরও তারা বিভিন্ন ওয়ার্ডে পানীয় জল সরবরাহের জন্য গভীর নলকূপ বসিয়েছে। বহুতল আবাসনগুলিতে গভীর নলকূপই পানীয় জলের প্রধান উৎস। এমতাবস্থায় এ দিন মেয়র কলকাতা শহরে আর্সেনিক দূষণের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে বাড়ি বাড়ি গঙ্গার পরিশোধিত জল পৌঁছে দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তাতে পরিবেশবিজ্ঞানীরা কিছুটা হলেও আশ্বস্ত হয়েছেন।

পরিবেশবিজ্ঞানীদের অনেকে অবশ্য বলছেন, শুধু নদীর জল শোধন করে সরবরাহ করে থেমে থাকলে চলবে না। কারণ, তাতে পানীয় জলের সমস্যা হয়তো মিটবে, কিন্তু আর্সেনিক দূষণ পুরোপুরি ঠেকানো যাবে না। তাই গভীর নলকূপ নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি প্রতিটি বহুতলে বৃষ্টির জল সংরক্ষণও বাধ্যতামূলক করার পরামর্শ দিয়েছিলেন তাঁরা। সেই মতো কলকাতা পুরসভা তাদের বিল্ডিং আইনে কিছু সংশোধন করেছিল। কিন্তু তা কার্যকর হয়নি। ‘‘কলকাতার বৃষ্টির জল যদি কলকাতার ভূস্তরে ফিরিয়ে দেওয়া না যায়, তা হলে আর্সেনিক সমস্যার পাকাপাকি সমাধান হবে না,’’ মন্তব্য এক পরিবেশবিজ্ঞানীর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Arsenic Waterpipe Municipality Drinking water
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE