মাস কয়েক আগেই আদালত বলে দিয়েছিল, বিধি না থাকায় জরিমানা নিয়ে বেআইনি নির্মাণকে বৈধ করতে পারবে না কলকাতা পুরসভা। আদালতের সেই নির্দেশ মাথায় রেখে এ বার জরিমানা দিয়েই বেআইনি নির্মাণকে বৈধ করানোর বিল পাশ হল বিধানসভায়।
বিরোধীদের অভিযোগ, পুরভোটের মুখে প্রোমোটারদের ‘খুশ’ করতেই টাকার বিনিময়ে শহরের বেআইনি নির্মাণকে আইনি করার বিল পাশ হল বিধানসভায়। অর্থাৎ, এত কাল যে ভাবে জরিমানা বা ‘রিটেনশন চার্জ’ নিয়ে বেআইনি নির্মাণকে আইনি করার রেওয়াজ ছিল, তাতে সরকার সিলমোহর লাগালো বলে মনে করছেন তাঁরা। সিপিএম ও বিজেপি-র অভিযোগ, পুরভোটের জন্যই তড়িঘড়ি আইন সংশোধন করে প্রোমোটারদের সুবিধা পাইয়ে দেওয়া হচ্ছে।
যদিও কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেন, “এত কাল এটা কনভেনশন ছিল। এ বার আইনে পরিণত হওয়ায় ছোটখোটো অনেক বাড়ির মালিকের সুবিধা হবে।” পুরসভা সূত্রের খবর, পুর-আইনে ওই ধরনের জরিমানা নিয়ে বেআইনি নির্মাণকে বৈধ করার কোনও সুযোগ ছিল না। তা সত্ত্বেও বাম ও তৃণমূল, দুই জমানাতেই টাকা নিয়ে বেআইনি নির্মাণ বৈধ করার কাজ চলে এসেছে।
এ বার ওই বিল পাশ হওয়ায় বড় বড় প্রোমোটারদেরও পোয়াবারো হবে বলে গুঞ্জন পুরসভার অন্দরমহলে। যা নিয়ে প্রশ্ন করতেই মেয়র শোভনবাবু বলে ওঠেন, “ও সব কথা বলাটাই কোনও কোনও সংবাদপত্রের অ্যাজেন্ডা।” কোনও বড় প্রোমোটারের স্বার্থ দেখা হবে না বলে জানিয়ে দেন তিনি। কিন্তু কে বড় আর কে ছোট, তা বাছার পদ্ধতি কার উপরে নির্ভর করবে, তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে পুর-মহলেই। একাধিক পুর-আধিকারিকের কথায়, “আইন না থাকায় একটা আগল ছিল। এ বার বাঁধভাঙা অবস্থা। যে পারবে, সে-ই সুযোগ নেবে।”
অন্য দিকে, ওই বিলের বিরোধিতা করে বিজেপি-র রাজ্য সম্পাদক রীতেশ তিওয়ারি বলেন, “পুরভোট আসন্ন। তড়িঘড়ি আইন সংশোধন করে প্রোমোটারদের বাড়তি সুবিধা পাইয়ে দেওয়া হল।” টাকার বিনিময়ে বেআইনি নির্মাণ আইনি করার বিষয়ে বিল আনার ঘটনাকে চরম অন্যায় বলে মনে করছেন প্রাক্তন মেয়র সিপিএমের বিকাশ ভট্টাচার্য। তাঁর কথায়, “পুরভোটের আগে টাকা কামানোর জন্য ওই বিল পাশ করা হয়েছে।”
প্রসঙ্গত, গত জুলাইয়ে হাইকোর্টে এক মামলার প্রেক্ষিতে বিচারপতি সৌমিত্র পাল রায় দেন, পুর-আইনের কোথাও রিটেনশন চার্জ নেওয়ার কথা বলা নেই। তাই পুর-কর্তৃপক্ষ টাকা নিয়ে কোনও অবৈধ নির্মাণকে বৈধ করতে পারেন না। বিচারপতির ওই রায়ের প্রেক্ষিতে অস্বস্তিতে পড়েন পুরবোর্ডের অনেকেই। তখন মেয়র পারিষদের এক সদস্য বলেছিলেন, “ওই প্রথার ফাঁক গলে লক্ষ লক্ষ টাকা ঢুকছে কারও কারও পকেটে।”
যদিও বিল্ডিং দফতরের একাধিক অফিসার জানান, রিটেনশন চার্জ বাবদ গত ২০১৩-’১৪ সালে পুরসভার আয় হয়েছিল প্রায় ৬৫ কোটি টাকা। ওই প্রথা বন্ধ হয়ে গেলে পুরসভার আর্থিক ক্ষতি হবে। সেই বক্তব্যকে মূলধন করেই রাজ্য সরকারের কাছে রিটেনশন নেওয়ার প্রথা আইনি করার জন্য সম্প্রতি প্রস্তাব পাঠায় পুর-প্রশাসন। কলকাতা পুর-আইন (১৯৮০) অনুসারে বিল্ডিং রুলের ৪০০ নম্বর ধারা সংশোধনের জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানানো হয়।
কলকাতা পুরসভার স্বার্থে এক ডজন পুর-আইনের সংশোধনী বিল পাশ হয়েছে বিধানসভায়। তার মধ্যে অন্যতম বেআইনি নির্মাণ আইনি করার বিষয়টি। বিল্ডিং আইন সংশোধনের সঙ্গে এ দিন বকেয়া সম্পত্তিকরের সুদের উপরে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড়ের বিষয়টি পাশ হয় বিধানসভায়। পুরসভার এক আধিকারিক জানান, শহরে বকেয়া সম্পত্তিকরের পরিমাণ প্রায় ১৩০০ কোটি টাকা। আর তা সময়ে না দেওয়ায় সুদ বাকি রয়েছে প্রায় হাজার কোটি টাকা। জরিমানা ধরে মোট ২৬০০ কোটি টাকা। পুর-নিয়মে জরিমানা মকুবের ক্ষমতা ছিল পুর-কর্তৃপক্ষের। সম্প্রতি সুদ মকুবের অধিকার মেয়র পরিষদের হাতে দেওয়ার জন্য রাজ্য সরকারের কাছে আবেদন জানায় পুর-প্রশাসন। পুরভোটের আগে সেই বিলও পাশ করানো হয় বিধানসভায়। স্বভাবতই ভোটের আগে এই জোড়া ‘জনমোহিনী’ ছাড় দেওয়ার ক্ষমতা পেয়ে উৎফুল্ল পুরবোর্ডের কর্তারা।
যদিও বিধানসভায় বিল্ডিং আইনের সংশোধনের খবরে খুশি নন পুরসভার বিল্ডিং দফতরের বহু অফিসার। তাঁদের বক্তব্য, শুধু টাকার কথা ভেবে দেখা হল। শহরবাসীর স্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভাবা দরকার ছিল। রিটেনশন প্রথার সুযোগ নিয়ে পাঁচতলা ভিতের একটা বাড়িতে আটতলা উঠে যাবে, যা বসবাসের পক্ষেও বিপজ্জনক। যে কোনও সময়ে বাড়ি ভেঙে ভয়াবহ কাণ্ড ঘটতে পারে। এ দিকটাও সরকারের বিবেচনার মধ্যে থাকা উচিত ছিল বলে মত তাঁদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy