Advertisement
E-Paper

শিকড়ে মিশে আছে ভালবাসা, আন্তরিকতা

উঁচু-নিচু সঙ্কীর্ণ ফুটপাথটা বাড়ির সামনে দিয়ে এঁকেবেঁকে দূরে গিয়ে মিশেছে। তারই গা ঘেঁষে বহু কালের বিবর্ণ মলিন বাড়িগুলি দাঁড়িয়ে যেন কালের প্রহর গুনছে। সেই ভিড়ে উঁকি দেয় নতুন রং হওয়া সবুজ, গোলাপি কিংবা নীলচে দেওয়াল।

আস্তিককুমার দত্ত

শেষ আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০১৫ ০০:৩৩
ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।

ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।

উঁচু-নিচু সঙ্কীর্ণ ফুটপাথটা বাড়ির সামনে দিয়ে এঁকেবেঁকে দূরে গিয়ে মিশেছে। তারই গা ঘেঁষে বহু কালের বিবর্ণ মলিন বাড়িগুলি দাঁড়িয়ে যেন কালের প্রহর গুনছে। সেই ভিড়ে উঁকি দেয় নতুন রং হওয়া সবুজ, গোলাপি কিংবা নীলচে দেওয়াল।

ও দিকে মোড়ের মাথায় বিকে পাল অ্যাভিনিউ মিশেছে নিমতলা ঘাট স্ট্রিটে। বাড়ির সামনে দিয়ে সেই রাস্তা সোজা গিয়ে মিশেছে স্ট্র্যান্ড রোডে। বাড়ির পিছনে কাশী দত্ত স্ট্রিট, পাশেই মদনমোহন দত্ত স্ট্রিট, দত্তপাড়া লেন আর মহম্মদ রমজান লেন। এই সব অলি-গলি-রাজপথ নিয়েই আমার পাড়ার চৌহদ্দি। রাজপথে এক দিকে যান যন্ত্রণার কর্কশ আর্তনাদ, অন্য দিকে হরিধ্বনি মুখরিত বিমর্ষ শ্মশানযাত্রীদের আনাগোনা। এ সব নিয়েই স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আমার পাড়া জোড়াবাগান-নিমতলাঘাট স্ট্রিট।

আজ আট পুরুষ এ পাড়ায় আমাদের পরিবারের বসবাস। আমার জন্ম হাটখোলার দত্ত পরিবারে। এই অঞ্চলটাই অতীতের হাটখোলা। বর্তমানে পুরসভার ২০ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্গত জোড়াবাগান এলাকার মধ্যে অবস্থিত। বাড়ির পাশেই ডাফ কলেজের বহু প্রাচীন পরিত্যক্ত বাড়িটি আগাছার উদ্ধত শাখা-শিকড়ে পরিবৃত হয়ে আজও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে। এক সময়ে এখানেই ছিল পুরনো ফৌজদারি আদালত, আরও পরে পুরনো জোড়াবাগান থানা।

গত কয়েক বছরে এলাকার প্রভূত উন্নতি হয়েছে। এখন রাস্তাঘাট নিয়ম করে দু’বেলা পরিষ্কার হচ্ছে, আলোকস্তম্ভে বসেছে জোরালো আলো, রাস্তার অবস্থাও ভাল। আগের মতো রাস্তায় জঞ্জাল পড়ে থাকে না, পুরসভার গাড়ি এসে নিয়মিত তা তুলে নিয়ে যায়। জল সরবরাহও আগের চেয়ে উন্নত হয়েছে। এলাকার কাউন্সিলর বিজয় উপাধ্যায় বাসিন্দাদের সঙ্গে ভাল জনসংযোগ বজায় রেখে চলেন।

এলাকার সবচেয়ে বড় উন্নয়ন বলতে নিমতলাঘাট শ্মশানের সংস্কার। আগে যেখানে ছিল নেশাখোড়দের আখড়া, শোনা যেত নানা অসামাজিক কাজকর্মের কথা সেই ছবিটা এখন বদলেছে। শ্মশান সংলগ্ন এলাকায় এসেছে আমূল পরিবর্তন। চারপাশ পরিচ্ছন্ন, বসেছে জোরালো আলো। সংস্কার হয়েছে রবীন্দ্র স্মৃতিসৌধটিরও।

এলাকার মন্দিরগুলির সামনেও বসেছে আলোকস্তম্ভ। নিমতলা শ্মশানের কাছেই বহু প্রাচীন আনন্দময়ী কালীমন্দির, আদিভূতনাথ মন্দির এবং ভূতনাথ মন্দিরকে কেন্দ্র করে এই এলাকায় বহু মানুষের যাতায়াত লেগেই থাকে। তেমনই মহম্মদ রমজান লেনে বটের শিকড়ে আবদ্ধ দুর্গেশ্বর মন্দিরটি বহু শতাব্দীর নীরব সাক্ষী। আকারে বিশাল এই শিবলিঙ্গের মাথায় জল ঢালতে হয় কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠে। আজও বহু মানুষ এই মন্দিরে ঢিল বেঁধে মানত করেন আর পথচলতি মানুষ দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে কপালে হাত ঠেকিয়ে এগিয়ে চলেন গন্তব্যে। এই সব পুরনো পাড়ায় আজও একটা গন্ধ পাওয়া যায়— সেই গন্ধে মিশে আছে ভালবাসা, আন্তরিকতা, আর শিকড়ের টান।

এলাকায় উদ্যান বলতে জোড়াবাগান পার্ক। সেখানে বসেছে পানীয় জলের পরিশোধনাগার। তাই পার্কের অনেকটাই সেই কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। দত্তপাড়া লেনে আছে সিআইটি পার্ক, সেখানে গাছপালা না থাকলেও পার্কটি ছোটদের খেলাধুলোর উপযোগী। সেখানেই উঁচু আলোকস্তম্ভে বসেছে জোরালো আলো। তেমনই এলাকার অদূরে এক সময়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া মেয়ো হাসপাতাল সম্প্রতি চালু হয়েছে। কাছেই কাঠগালা— কাঠ ব্যবসায়ীদের বড় আড়ত। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কাঠ ব্যবসায়ীরা এখানে পাইকারি কাঠ কিনতে আসেন।

এলাকার বাজার বলতে কাছেই আহিরীটোলা বাজার, আর কিছুটা দূরে নতুন বাজার। তবে সময়ের সঙ্গে অবাঙালিদের প্রভাব বাড়ায় নতুন বাজারে আগের মতো মাছের জোগান নেই। এটা মাছে-ভাতে বাঙালির পক্ষে বেশ কষ্টদায়ক।

এ পাড়ার পুজো-পার্বণ বেশ আকর্ষণীয়। পারিবারিক দুর্গাপুজো ছাড়াও হয় বেশ কিছু সর্বজনীন পুজো। তবে সময়ের সঙ্গে বেড়েছে এলাকার জগদ্ধাত্রী পুজো। কাছাকাছির মধ্যে প্রায় ১০-১২টি পুজো হয় সাড়ম্বরে।

তবে এলাকায় কিছু সমস্যাও আছে। আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তা নিমতলা ঘাট স্ট্রিট ‘নো পার্কিং জোন’ হওয়ায় গাড়ি রাখার সমস্যা হয়।

তবে আজকের কথা বলতে বলতে মনে পড়ে যায় ফেলে আসা দিনের কথা। সে সময় আমাদের পাড়াটা ছিল বেশ অন্য রকম। যানবাহন মানুষজন ছিল কম, রাস্তাঘাট আজকের তুলনায় বেশ ফাঁকা থাকত। তখন দু’বেলা নিয়ম করে রাস্তার ধারে চাপা কলে হোস পাইপ লাগিয়ে রাস্তা ধোয়া হত।

অন্যান্য পাড়ার মতো রকের আড্ডার সংস্কৃতি এ পাড়ায় বড় একটা ছিল না। তবে রাম শেঠ লেনের মুখে ডেকরেটারের দোকানের সামনে ফুটপাথ জুড়ে তক্তপোশের উপরে বসত আড্ডা। এর সঙ্গে চলত তাস খেলা— তাতে যোগ দিতেন পাড়ার নামী ডাক্তার থেকে বিত্তবানেরা। তবে স্মৃতির খাতায় নাম লিখিয়েছে এ অঞ্চলের ঘুড়ি ওড়ানোর সংস্কৃতি। অক্ষয়তৃতীয়া কিংবা বিশ্বকর্মা পুজোর দিন সেই ভোকাট্টা রবটা যেন আচমকাই হারিয়ে গেল।

ছেলেবেলায় আমরা বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে ঠাকুরদালানের সামনের প্রাঙ্গণে ডাংগুলি, ক্রিকেট ইত্যাদি খেলতাম। মনে পড়ে এই জোড়াবাগান পার্কেই ক্রিকেট খেলতেন প্রয়াত জগমোহন ডালমিয়া। তেমনই এই অঞ্চলেই থাকতেন মোহনবাগান ক্লাবের প্রবাদপ্রতিম প্রেসিডেন্ট ধীরেন দে।

এ অঞ্চলের বিশিষ্ট বাড়িগুলির মধ্যে রায়বাহাদূর সতীশ চৌধুরীর বাড়ি, বসাকদের বাড়ি, উমাচরণ লাহার বাড়ি এবং চৌধুরী বাড়ি উল্লেখযোগ্য। আমাদের বাড়িটাও নানা কারণে প্রসিদ্ধ। সেকালে কাশীনাথ দত্ত বিধবা বিবাহের সমর্থনে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। হাটখোলার দত্তবাড়ি সুভাষচন্দ্র বসুর মামার বাড়ি বলে পরিচিত।

তবে একটা ব্যাপার খুব কষ্ট দেয়। তা হল অনেকেই এই এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। এলাকায় দিনে দিনে বাড়ছে আবাঙালি সম্প্রদায়ের মানুষ। তবে এখানে বাঙালি-অবাঙালির শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। আজও পাড়ার রাস্তাঘাটে যখন নবীন-প্রবীণদের সাক্ষাৎ হয় বয়সে ছোটরা পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেন, সম্মান দিয়ে কথা বলেন।

পাড়া থেকে হারিয়ে গিয়েছে কিছু স্বাদ! হরিচরণ মল্লিকের দোকানের সেই সরের নাড়ু কিংবা ওড়িশাবাসী বটার দোকানের সেই হিঙের কচুরি আজ কোথায়?

তবে আগের মতো আর নতুন করে বন্ধুত্ব হয় না। কোথাও যেন একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছে। তার কারণ নানা অঞ্চলের মানুষ এসে একটা মিশ্র সংস্কৃতি সৃষ্টি করেছে পাড়ায় পাড়ায়। হারিয়েছে আগেকার আন্তরিকতা, মূল্যবোধ। বেড়েছে দৈনন্দিন জীবনের চাহিদা। সেই দৌড়ে সামিল আমরা সকলেই।

লেখক হাটখোলা দত্ত পরিবারের সদস্য

Astik Kumar Dutta kolkata
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy