Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

ছেলেকে না দেখলে আমিও কি বুঝতাম

কোথাও গন্ডগোল হচ্ছে, আন্দাজ করেন গৃহশিক্ষক। বাবা-মাকে বোঝান, মেয়ের কাউন্সেলিং দরকার। চাপা স্বরে বাবা বলেন, “আস্তে বলুন। কেউ শুনলে বিপদ।”

দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০১৭ ০২:৪৬
Share: Save:

ক্লাসের মাঝে দাঁড়িয়ে হাঁ করে তাকিয়েছিল মেয়েটা।

‘‘ভারত কবে স্বাধীন হয়েছিল?’’

মেয়েটি চুপ।

“স্বাধীনতা দিবস কবে বলতে পারছ না!” সহপাঠীদের হাসিতে ফেটে পড়ে হাওড়ার নামী ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির ঘর। মেয়েটির ভিতরে যে কী ঝড় চলছে, তা আন্দাজ করতে পারেন না শিক্ষিকা। তা বুঝতে পারে না ওর কাছের লোকেরাই। তাই বাড়িতেও চলে ভর্ৎসনা।

কোথাও গন্ডগোল হচ্ছে, আন্দাজ করেন গৃহশিক্ষক। বাবা-মাকে বোঝান, মেয়ের কাউন্সেলিং দরকার। চাপা স্বরে বাবা বলেন, “আস্তে বলুন। কেউ শুনলে বিপদ।” শিক্ষক বোঝাতে পারেন না, মেয়েটিকে শেখানোর অন্য পদ্ধতি আছে। অথচ প্রতিনিয়ত সমালোচনায় যে তার মন ভেঙে যাচ্ছে, তাতে পাত্তা দিতে নারাজ বাবা-মা।

এই মেয়েটির সমস্যা আমিও হয়তো বুঝতাম না, যদি না আমার আড়াই বছরের ছেলের অটিজম সম্পর্কে জানতাম। ছেলে ওর বয়সের আর পাঁচটা বাচ্চার থেকে যে আলাদা, তা বুঝতে দেরি হয়নি। কথা বলে না, ডাকলে সাড়া দেয় না, চোখের দিকে তাকায় না, ভিড়ের মধ্যেও এক কোণে একা বসে খেলে।

চিকিৎসক জানান, থেরাপি শুরু করতে হবে। বাড়িতেও সময় দিতে হবে। ওর মতো করে খেলতে হবে, বুঝতে হবে ওর প্রতিটি ব্যবহার। হা-হুতাশ না করে এমন শিশুদের নিয়ে কাজ করা একটি সংগঠনের দ্বারস্থ হই। শুরু হল ‘বিহেভিয়রাল থেরাপি।’ যার প্রধান শর্ত, ছেলের সঙ্গে দুর্দান্ত সম্পর্ক তৈরি করা এবং উৎসাহ দেওয়া। এ ভাবে অনেক অভিভাবকই ছেলেমেয়েকে পড়াশোনা, সামাজিকতা শেখাচ্ছেন। নিজেরাও শিখছেন তাদের আলাদা না করে রাখতে। এই ‘ইনক্লুশন’ পদ্ধতিটাই হাতিয়ার।

কিন্তু এ সব শেখালেই কি আমাদের বাচ্চার চলার পথটা মসৃণ হয়ে যাবে? শিক্ষিত সমাজকেও শিখতে হবে সহবত। স্কুল ও অন্য প্রতিষ্ঠানকে জানাতে হবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর অধিকার। রাইট টু ডিসেবিলিটি অ্যাক্ট, অ্যাকোমোডেশন ফর স্পেশ্যাল চাইল্ড ইন স্কুল, ডিসেবিলিটি, কারিক্যুলাম অ্যাডাপটেশন নিয়ে ইন্টারনেটে খুঁজলেই মিলবে তথ্য।

সরকারি নীতি না জানলেও সন্তানদের অধিকারের জন্য লড়াই করছেন আমার মতো অনেকেই। গড়িয়ার ঝুমা লাহা ছ’বছরের অটিস্টিক ছেলেকে ভর্তি করিয়েছিলেন এলাকার সাঁতার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। জলে নামবে বলে আত্মহারা ছেলে। কিন্তু তাকে বাধা দিয়ে বলা হয়, “ওকে আরও পাঁচ জন প্রশিক্ষক দিয়ে ঘিরে রেখে সাঁতার শেখাতে হবে। না হলে বাকিদের ক্ষতি করবে।” বিষয়টি বুঝতে পেরে ছেলেটি মাথা ঠুকে কাঁদতে থাকে। অনেকে মন্তব্য করেন, ছেলেটি জলে নামলে ওর রোগ অন্যদের মধ্যেও ছড়াবে। ঝুমার লড়াই থামেনি। ছেলেটির জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করতে বাধ্য হয়েছিল সাঁতার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি।

আরও পড়ুন: মনোজের খুনি ধরতে অভিযান ভিন্‌ রাজ্যে

আট বছরের অটিস্টিক ছেলেকে নিয়ে পুজোর বাজার করে মেট্রোয় ফিরছিলেন আর এক মা। গরমে ক্লান্ত ছেলে কান্নাকাটি করছে। হঠাৎই মেট্রোর এক রক্ষী বলেন, “ও কাঁদছে কেন, ওর কি কোনও অসুবিধা আছে?” মা উত্তর দিয়ে চলে যাওয়ার সময় শুনতে পান ওই রক্ষীর মন্তব্য, “এমন বাচ্চাকে নিয়ে মেট্রোয় ওঠারই নিয়ম নেই।” প্রতিবাদে মেট্রোর নিয়মকানুন দেখানোর দাবি জানিয়ে ছেলেকে নিয়ে স্টেশনেই বসে পড়েন মা। পরে অন্য এক মেট্রোকর্মী ক্ষমা চাওয়ায় ঝামেলা মেটে।

এমনটা আকছার ঘটছে, কিন্তু তা জনসমক্ষে আসে না। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী স্কুলগুলি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ছেলেমেয়েদের ভর্তি-সহ সমস্ত সুযোগ-সুবিধা দিতে বাধ্য। শুধু বিশেষ শিক্ষক নয়, পরীক্ষার সময়ে রিডার, রাইটার, প্রম্পটার দিতে হবে। এমনকী অটিজম, সেন্সরি প্রসেসিং ডিসঅর্ডার, লার্নিং ডিজেবিলিটি আছে এমন শিক্ষার্থীর জন্য আলাদা ব্যবস্থা করতে হবে। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন পরীক্ষার্থীর জন্য প্রশ্নপত্রের ধরনও বদলানোর নিয়ম সরকারি খাতায় আছে। কিন্তু বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের নিয়ে কাজ করা একটি সংগঠনের কর্মী ইন্দ্রাণী বসুর কাছে জানতে পারি, বেশির ভাগ অভিভাবকই এখনও নিজের বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন সন্তানের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে অন্ধকারে। ফলে কিছু স্কুল আইন জানলেও তা মানতে চায় না।

কিন্তু তার আগে আছে স্কুলে ভর্তির লড়াই। কথা বলতে না পারলে ভর্তি নেবে না স্কুল। কিন্তু অটিস্টিক বাচ্চাদের অনেকেই কথা বলে দেরিতে। তা ছাড়া ভর্তি নিলেই তো লড়াই শেষ নয়। যেমন হয়েছে বাঘা যতীনের সঞ্জীব পালের ক্ষেত্রে। তাঁর মাইল্ড অটিস্টিক ছেলেকে বেসরকারি স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলেন। পরে জানতে পারেন, দিদিমণিরা ওকে স্টাফ রুমের কোণে বসিয়ে রাখেন। পরে ওকে একটি স্পেশ্যাল স্কুলে ভর্তি করা হয়। এখন ও দিব্যি এগোচ্ছে।

কিন্তু যদি ওদের স্পেশ্যাল স্কুলের ঘেরাটোপেই রাখতে হয়, তা হলে ‘ইনক্লুশন’-এর এই ঢক্কানিনাদ কীসের!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Autism অটিজম
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE