Advertisement
০৫ মে ২০২৪

দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় হেঁশেলে উঁকি বাঙালি রসনার

বাঙালি নেমন্তন্ন-বাড়ির মহাতারকা মালাইকারি না কি আদতে বাঙালিই নয়! নারকোলের দুধে পুষ্ট চিংড়ির পদটি আসলে মালয়েশিয়া ঘুরেই বাংলা মুলুকে এসে পৌঁছেছে। রুজির টানে মালয় দেশে রবার বাগানে পাড়ি দেওয়া দক্ষিণ ভারতীয়দের মাছ রান্নার এই শৈলীই একদা দক্ষিণ-পুব এশিয়া জয় করেছিল। সেখান থেকেই এই গঙ্গাতীরের দেশে তার আবির্ভাব।

ঋজু বসু
শেষ আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০২:২০
Share: Save:

বাঙালি নেমন্তন্ন-বাড়ির মহাতারকা মালাইকারি না কি আদতে বাঙালিই নয়! নারকোলের দুধে পুষ্ট চিংড়ির পদটি আসলে মালয়েশিয়া ঘুরেই বাংলা মুলুকে এসে পৌঁছেছে।

রুজির টানে মালয় দেশে রবার বাগানে পাড়ি দেওয়া দক্ষিণ ভারতীয়দের মাছ রান্নার এই শৈলীই একদা দক্ষিণ-পুব এশিয়া জয় করেছিল। সেখান থেকেই এই গঙ্গাতীরের দেশে তার আবির্ভাব। ইতিহাসবিদদের একটি তত্ত্ব বলছে, বাঙালি সেই মালয়কারিকে নিজের সুবিধামতো আত্মীকরণ করেছে। এমনকী, মুখে-মুখে তার নামটাও বেমালুম পাল্টে হয়েছে মালাইকারি।

আজকের কলকাতায় মেনল্যান্ড চায়নায় ঢুকলে মালুম হবে, ভিন্ ঘরানার রান্নাকে নিজের জিভের চাহিদামাফিক আত্মীকরণের ট্র্যাডিশন এখনও বহাল। তাই সাম্বাল সসে রান্না ইন্দোনেশীয় তথা জাভা গ্রিল ফিশ বলে যে পুরুষ্টু মৎস্যখণ্ডটি আপনার পাতে এল, তার মধ্যে হুবহু দক্ষিণ-পুব এশিয়ার ঘ্রাণ খুঁজতে যাওয়ার মানে হয় না। শুকনো মাছ বা কুচো চিংড়ির পেস্টভরপুর সাম্বাল সস্ আদতে কাঠবাঙালের শুঁটকির জাতভাই। কিন্তু রেস্তোরাঁয় শুঁটকির সুগন্ধে ভদ্রজনেরা কতটা ধাতস্থ হবেন ভেবেই সাম্বালের তেজ কিছুটা স্তিমিত রাখা হয়েছে। সাম্বালের কষাটে স্বাদের সঙ্গে হাল্কা মিষ্টি ভাব মিশে মাছটি কিন্তু আমখাইয়ের মনে ধরছে। আর খেতে ভাল লাগলে, রান্নার ঠিকুজি-কুষ্ঠি নিয়ে কোন বেরসিক মাথা ঘামাবে!

বিজাতীয় ঘরানাকে নিজের রুচিমাফিক আপন করার এই রীতি মেনেই মেনল্যান্ড চায়নায় চলছে এশিয়া কুইজিন উৎসব। যা সামগ্রিক ভাবে এ দেশের দক্ষিণ-পুব এশিয়ার ভোজের প্রতি টান বলেই দেখছেন এ শহরের খাদ্যরসিক তথা রেস্তোরাঁকর্তারা। রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের মোড়ে আর একটি রেস্তোরাঁর কর্তা জয়দীপ চট্টোপাধ্যায় সেটাই বলছিলেন। তাঁর কথায়, “ইদানীং বাঙালি সস্তার উড়ানে বেশ ঘন ঘন ব্যাঙ্কক, সিঙ্গাপুর, কুয়ালা লামপুরে ঘুরে আসছে। তাঁদের অনেকেরই সাউথ-ইস্ট এশিয়ান কুইজিনের জন্য মন আনচান করে।”

রাসবিহারীর মোড়ে ‘দ্য স্ট্রেটস’ নামে একটি রেস্তোরাঁ খুলে ফেলেছেন জয়দীপবাবু। চেনা চাইনিজের বদলে বুক ঠুকে তারা শুধু সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার খানা পেশ করে। এমনিতে দেশের অন্য মেট্রো শহরগুলোর মতো কলকাতার পাঁচতারা হোটেলগুলোতেও দক্ষিণ-পুব এশিয়ার বিশেষ কদর। ওবেরয় গ্র্যান্ডের বানতাই ছাড়াও আইটিসি সোনার-এ প্যান এশিয়ান বা পার্কের জেন রয়েছে। হোটেল হিন্দুস্তান ইন্টারন্যাশনালও সদ্য দ্য ওরিয়েন্টাল এক্সপ্রেস নামে একটি রেস্তোরাঁ চালু করেছে। কিছু স্ট্যান্ড অ্যালোন রেস্তোরাঁর পদেও রয়েছে তাই, মালয়দেশীয় বা কোরিয়, জাপানি পদ। সেক্টর ফাইভে সদ্য জন্ম নিয়েছে অ্যাহয় এশিয়া বলে একটি রেস্তোরাঁ।

মেনল্যান্ড চায়না-কর্তা অঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ও চান মুম্বইয়ের পরে কলকাতাতেও এশিয়া কিচেন মেনল্যান্ড চায়না নামে একটি আস্ত রেস্তোরাঁ পত্তন করতে। আপাতত এই ফুড ফেস্টিভ্যালেই তাঁর ভাবনার তুমুল মহড়া চলছে। এশীয় হেঁশেলের টানে খেতে এসে বাঙালি তাই চাখছে কোরীয় কসরতে সয়াস্নাত চটপটা বার্বিকিউড পেপার চিকেন বা সিঙ্গাপুরের কারিপাতা, তেঁতুল, নারকোলের দুধের ত্র্যহস্পর্শে জমকালো কারিড শ্রিম্প। শাকাহারী বন্ধুদের চমকে দেওয়ার মতো আকর্ষক সব রান্নাও মজুত। বাদামবাটার পেস্ট মাখিয়ে সুস্বাদু শিতাকে মাশরুমের সাতে অগ্রাহ্য করার নয়। মায়ানমারের খাউসোয়েকেও চিকেনযোগে একটু উল্টেপাল্টে পরিবেশন করা হচ্ছে। রয়েছে ইন্দোনেশীয় পোলাও নাসিগোরেঙ্গ। খাস তাইল্যান্ড থেকে পুঁচকে ধানিলঙ্কাযোগে ঝাল-ঝাল চিকেন কাপরাও-ও বাঙালির জিভে খুলছে।

দক্ষিণ-পুব এশিয়ার রান্না এমনিতে মালাইকারির ভক্ত বাঙালির ভাল লাগারই কথা। মাংসের লেবুপাতা সুরভিত পদ রেনডাংয়ের মধ্যে যেমন অনেকেই চেনা কষা মাংসের ছাপ পান। শিল্পে লগ্নি টানতে সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়াকেই এখন পাখির চোখ দেখছে রাজ্য সরকার। স্বাদগত বেরাদরির দিক দিয়ে সেতু বাঁধার কাজটা কিন্তু শহরের রেস্তোরাঁই শুরু করে দিল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE