বড়জোর বছর পঞ্চাশ আগের কথা। বাগবাজার থেকে বকুলতলা আর বড়বাজার থেকে বেলেঘাটা এ সময় উপচে পড়ত নানা রং ও স্বাদের আমে। আম-বিলাসী অধ্যাপক সুকুমার সেনের বাগানের কলামোচা, বেলখাস, নম্বুরি-র সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে কল্যাণী দত্ত এ-ও যোগ করেছেন, সে সব কলকাতার বাজারে পাওয়া যেত না। তবে যা পাওয়া যেত তা-ই বা কম কী! হিমসাগর, ল্যাংড়ার সঙ্গে গৃহস্থের থলেতে ঢুকত কিষেনভোগ, গোলাপখাস, তোতাপুলি। আসল বোম্বাই আমের ভিতরটা হত আলতা-গোলা লাল। ভারতচন্দ্র রায়ের বিদ্যাসুন্দর-এ বর্ণিত লালফুলি আম পাওয়া যেত কালীঘাট বাজারে। গল্পের সেই নবাবি ‘কহিতুর’ সাধারণ মানুষ না পেলেও, বিহার উত্তরপ্রদেশ থেকে সরেস আমের জোগানে কলকাতার বাজার ভরে যেত আষাঢ়ের চৌসা-দশেরি পর্যন্ত। জামাইষষ্ঠীর তত্ত্ব আলো করে থাকত আমের ঝুড়ি। মরসুমে এক দল খাইয়েকে আম খাওয়ানোর জন্য গলার হার বন্ধক দিতেও পিছপা হত না আম-হুজুগে বাঙালি।
আমের এমন বিচিত্র পরিবেশন উপভোগের মানুষও ছিলেন তখন। অনেকেই ভরপেট খাওয়ার পরেও তিরিশ-চল্লিশটা আম খেতে পারতেন। কাশীতে পরমানন্দ ব্রহ্মচারী নামে বিখ্যাত হওয়ার আগে, সংসারজীবনে সুখচরের বাঁড়ুজ্জেমশাই এক বার ব্রাহ্মণভোজনে লুচি মিষ্টি সব খাওয়ার পর বাজি ধরে ৬৪টি আম খেয়েছিলেন বলে সাক্ষ্য আছে যতীন্দ্রমোহন দত্তে। তবে এই মুনকে রঘুদের মধ্যে কেউ কেউ হতেন আগমার্কা আমের রসিক। গামছা দিয়ে তাঁদের চোখে বেঁধে পাতে দেওয়া হত আম। ওস্তাদ খেয়ে বলে দিতেন অনায়াসে— পেয়ারাফুলি, ধোনা, কপাটভাঙা, ইলশেপেটি।
সাধারণ বাড়িতেও আম খাওয়া নিয়ে কত না কেতা। আম কাটার আলাদা বঁটি থাকত। পাছে অন্য ফল কেটে ফেলা হয়, তাই ধুয়ে-মুছে যত্ন করে অনেকে লুকিয়ে রাখতেন সেই বঁটি। খাওয়ার আগে ঠান্ডা করে নেওয়া ছিল অবশ্যকর্তব্য। আম-দুধ খাওয়ার জন্য থাকত বিশেষ পাথরের পাত্র। থালা ভরা আম-ক্ষীর পরিবেশন করা হত অতিথিকে।
রবীন্দ্রনাথ হেমচন্দ্র সত্যেন্দ্রনাথ-সহ বাঙালি কবিকল্পনায় জায়গা করে নিয়েছে আম। স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র এ দেশের সিভিল সার্ভিসের সাহেবদের ‘মনুষ্যজাতিমধ্যে আম্রফল’ বলে মনে করতেন। সেই ‘রাজা ফল’ খাওয়াতেও বিশেষ যত্নের কথা করিয়ে গেছেন: সদ্য গাছ থেকে পেড়ে এ ফল খেতে নেই। কিছু ক্ষণ ‘সেলাম-জল’-এ ফেলে রেখে ঠান্ডা করে নিতে হয়। যদি জোটে, তবে সেই জলে একটু খোশামোদ-বরফ দিতে হয়। তার পর ঠান্ডা হলে ছুরি চালিয়ে স্বচ্ছন্দে খাওয়া যায়।
জ্যৈষ্ঠ মাস পড়ে গেল। বাজারে ঢুঁ মারলেই নজর কাড়ে থরে থরে সাজানো আমের পসরা। ‘সেরা জিনিস’ বলে যখন দোকানি হাতে মহার্ঘ আলফানসো ধরিয়ে দিতে চায়, তখন অতীতের আম-বিলাস নিয়ে স্মৃতিমেদুরতা ঘিরে ধরে বইকি! ছবিতে মহানগরে ফল-বাজারে আমের নিলাম, ২০০৩ সালের ছবি।
স্মরণে উনিশে
বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষার মর্যাদা দেওয়ার দাবিতে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল ১৯৬১-র ১৯ মে। পুলিশের গুলিতে এগারো জন শহিদ হন। বাঙালির কাছে এ এক অতি গুরুত্বপূর্ণ দিন, এ দেশে মাতৃভাষার জন্য এমন রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম আর কোনও ভাষার জন্য হয়েছে কি? ‘শিলচর ভাষা দিবস’ নামেও পরিচিত দিনটির স্মরণে শুধু অসমেই নয়, বাংলা তথা কলকাতাতেও নানা অনুষ্ঠান হচ্ছে। এই আয়োজনে শামিল ‘লিটল ম্যাগাজ়িন ফোরাম’ও। তাদের চাওয়া— নতুন প্রজন্মের বাঙালিও এই দিনটি সম্পর্কে জানুক, লিখুক, বলুক। অবশ্যই থাকবে ২১ ফেব্রুয়ারির গুরুত্ব আলোচনাও। ১৯ মে, সোমবার স্কটিশ চার্চ কলেজের এমএলবি প্রেক্ষাগৃহে ফোরামের আয়োজনে শিলচর ভাষা শহিদ দিবস স্মরণে বলবেন পবিত্র সরকার ও আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়; কবিরা পড়বেন কবিতা। ছবিতে শিলচরে উনিশে মে ভাষা শহিদ স্মারক।
আত্ম-নির্মাণ
‘হু মেড হু’— এই প্রশ্ন থেকেই জন্ম এক প্রদর্শনীর। আত্মদ্বন্দ্ব, শান্তি, নিজের ভিতরে বয়ে নিয়ে চলা সংলাপ সেখানে পরতে পরতে উন্মোচনের চেষ্টা: কী ভাবে আমরা অস্তিত্বের ছাঁচ গড়ি, বিশৃঙ্খলা থেকে বেছে নিই সিদ্ধান্ত, আঁকি ভবিষ্যতের রূপরেখা। প্রদর্শনীর কেন্দ্রে আছে একটি কবিতা, যার উপজীব্য, আমাদের প্রতিটি সিদ্ধান্ত কেমন করে আত্মার গভীরে প্রতিধ্বনিত হয়। অয়ন মুখোপাধ্যায়ের কল্পনা ও সঙ্কলনে, সহশিল্পী অদিতি দাস ত্রিনাথ মজুমদার ও অভিষেক দাশগুপ্তের দৃশ্যশিল্প, গান ও কবিতায় ধরা পড়েছে ব্যক্তি ও সমষ্টির অন্তঃসত্তার বুনন— শব্দ, সুর, চিত্রকে জড়িয়ে। অন্য রকম, ‘ইন্টারডিসিপ্লিনারি’ এই প্রদর্শনীটি চলছে বিজয়গড়ের এএম (আর্ট মাল্টি-ডিসিপ্লিন) স্টুডিয়োয়। ১৪ জুন পর্যন্ত, রবিবার বাদে রোজ বিকেল ৪টে-৮টা।
বরাক ও বঙ্গ
উনিশে মে স্মরণে ‘অনীক’ নাট্যদল গত বছর থেকেই আয়োজন করে আসছে ‘বরাক বাংলা নাট্য উৎসব’। দ্বিতীয় বছরের উৎসব তপন থিয়েটারে ১৯ ও ২০ মে, প্রথম দিন শিলচরের দু’টি নাট্যগোষ্ঠীর নাটক। ২০১২ সালে অর্জুন নমশূদ্র নামে এক মৎস্যজীবী আত্মহননের পথ বেছে নেন তিনি অসমের অধিবাসী এক বাঙালি, অনুপ্রবেশকারী নন— তা প্রমাণ করতে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই ‘গণসুর’ নাট্যদলের নাটক লিগাসি কোড ১৯৬১, দেখা যাবে উৎসবে। আবার একই ঘটনার সূত্র ধরে লেখা আত্মহত্যার পরে নাটকটিও, ‘নন্দিনী সাহিত্য ও পাঠচক্র’-এর প্রযোজনায়। দু’টিরই রচয়িতা অরিজিৎ আদিত্য। ২০ মে সন্ধ্যায় অভিনীত হবে দেবাশিসের নির্দেশনায় অনীকের দর্শকধন্য প্রযোজনা আক্ষরিক, পঞ্চানন কর্মকারের জীবনাশ্রয়ী।
সসম্মানে
নাট্যচর্চা মানে শুধু নাট্যপ্রযোজনা নয়। আলোচনা সম-আলোচনা, পূর্বজদের স্মরণ, ভবিষ্যতের রূপরেখা তৈরি, এ সবও। ‘গণকৃষ্টি’ নাট্যগোষ্ঠী এ নিয়ে খুবই সচেতন। তার প্রতিফলন পড়ে ওদের নানা নাট্যসম্মান অর্পণ-প্রয়াসে। প্রয়াত নাট্য-সমালোচক ধরণী ঘোষের নামাঙ্কিত স্মৃতি সম্মানে এ বছর ভূষিত হবেন শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়। এ ছাড়াও দলের প্রয়াত সদস্যের নামাঙ্কিত ইন্দ্রনীল লাহিড়ী স্মৃতি সম্মানে বরণ করা হবে প্রবীণ রূপসজ্জাশিল্পী পঞ্চানন মান্নাকে; ২১ মে সন্ধ্যা ৬টায় অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস-এর কনফারেন্স হল-এ। পরে ‘তীর্থঙ্কর মুখোপাধ্যায় স্মারক ভাষণ’, বক্তা দেবশঙ্কর হালদার। দ্বিতীয়ার্ধে ‘নির্দেশকের মুখোমুখি নির্দেশক’, দুই নাট্যপরিচালক দেবাশিস রায় ও জয়রাজ ভট্টাচার্যের কথালাপ।
তথ্যচিত্রে
সিনেমার চর্চায় কলকাতা ইদানীং শুধু কাহিনিচিত্র নিয়েই মেতে থাকে, তথ্যচিত্রের খোঁজ রাখে না তত। অথচ এ শহরেই আছে নবীন-প্রবীণ বহু তথ্যচিত্রকার: বাংলা ও ভারতের মানুষ, সময়, সমাজ, পরিবেশের সঙ্কট ও সম্ভাবনা তাঁদের ছবির সূত্রে পৌঁছে গিয়েছে দেশে-বিদেশে। তথ্যচিত্র-নির্মাতাদের গোষ্ঠীবদ্ধতা বা তার দৃশ্যমান উদ্যোগ সে ভাবে চোখে না পড়াও হয়তো এ শহরের উদাসীনতার এক কারণ। অপরিচয় মুছতে এগিয়ে এসেছে কলকাতা ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন ফর আর্টস লিটারেচার অ্যান্ড কালচার (কেআইএফএএলসি), আজ ও কাল বিকেল ৪টে থেকে পি ৫৩৪ রাজা বসন্ত রায় রোডে তাদের প্রেক্ষাগৃহে দু’দিন ব্যাপী তথ্যচিত্র উৎসব। তিনটি ডকু-ফিচার’সহ মোট ন’টি ছবির প্রদর্শন, উৎসব কিউরেট করেছেন ইন্দ্রনীল সরকার।
স্মৃতি সততই
সকলেরই প্রায় জানা হয়ে গিয়েছে, ৭৮তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হচ্ছে সত্যজিৎ রায়ের অরণ্যের দিনরাত্রি— ‘কান ক্লাসিকস’ বিভাগে। শর্মিলা ঠাকুর আর সিমি গরেওয়াল উড়ে গিয়েছেন ভারত থেকে, আর ওখানে আছেন বিশ্বখ্যাত পরিচালক ওয়েস অ্যান্ডারসন, এ ছবি রেস্টোর করার কথা তিনিই বলেছিলেন কয়েক বছর আগে, বলেছিলেন তাঁর নিজের সত্যজিৎ-প্রীতির কথা, এ ছবির প্রতি তাঁর আলাদা একটা শ্রদ্ধার জায়গা আছে, সে কথা। ১৯৭০-এ মুক্তির পর প্যারিস ও নিউ ইয়র্কে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল সত্যজিতের এই ক্লাসিক, বিশেষত ‘শেখর’ চরিত্রে রবি ঘোষের অভিনয়ের কেমন জয়জয়কার হয়েছিল— ধরা আছে অরণ্যের দিনরাত্রি-র অপর্ণার সাম্প্রতিক বয়ানে। ১৯ মে কানে যখন এ ছবির ‘ফোর-কে’ সংস্করণ দেখানো হবে, গ্রীষ্মের কলকাতাও স্মৃতিমেদুর হবে বহুদূর থেকে। ছবিতে বিখ্যাত সেই ‘মেমরি গেম’-এর দৃশ্য।
নব পরিচয়
‘পাপেট’ শিল্পকলা এমন এক শাখা যেখানে সব শিল্পের মেলবন্ধন, তাই প্রতি বছর বিশেষত গ্রীষ্মের ছুটিতে পাপেট-সহ শিল্পের নানা শাখার কর্মশালা আয়োজন করে থাকে কলকাতার ‘ডলস থিয়েটার’। ছোট-বড় সকলে যোগ দেন সমান উৎসাহে। আগামী ২৪ ও ২৫ মে দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৪টে দু’টি কর্মশালা হবে ৭৪বি সেলিমপুর রোডে ডলস থিয়েটারের পাপেটোরিয়াম-এ। ২৪ মে ‘ওয়ার্ডটুন’ কর্মশালায় প্রশিক্ষক হিসেবে থাকবেন শুভেন্দু সরকার, আর পরদিন তালপাতার সেপাই (ছবি) তৈরির কর্মশালায় মদনমোহন দত্ত। ওয়ার্ডটুন নিয়ে আজকাল খুব ভাল কাজ হচ্ছে নানা জায়গায়, একটি শব্দের বর্ণগুলিকে চরিত্র দান করে শব্দটির একটা অর্থবহ ছবি তৈরি করা হয় ওয়ার্ডটুন-এ। আর তালপাতার সেপাই তো আজকের বড়দের খুব চেনা, কর্মশালাটির উদ্দেশ্য এই সহজ সরল লোকজ শিল্পের সঙ্গে এই প্রজন্মের সকলের পরিচয় করানো।
আপন কথা
গল্প, কবিতা, উপন্যাস, সিনেমায় উঠে এসেছে মেটিয়াবুরুজ। প্রাতিষ্ঠানিক চর্চাও হয়েছে কলকাতার এই জনপদ নিয়ে, বিশেষত নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের বসবাস-সূত্রে ইতিহাস-চর্চায় স্থান পেয়েছে মেটিয়াবুরুজ; দেশে-বিদেশে বহু বই প্রকাশিত নবাবকে নিয়ে। ওয়াজেদ আলি শাহের জন্মদ্বিশতবর্ষের উদ্যাপন-আবহে এ বার মেটিয়াবুরুজ থেকেই প্রকাশ পেল একটি বই, মেটিয়াব্রুজ: দর্জিমহল্লার কথকতা (প্রকা: কালি কলম ও ইজেল)। লেখক মহ: ফারুক ইকবাল এই এলাকার এক দর্জি-কারিগর, আট পুরুষ ধরে বসবাসের সূত্রে তিনি আনুমানিক তিনশো বছর ধরে মেটিয়াবুরুজে বাঙালি বসতি ও তাঁদের জীবন-জীবিকা প্রবাহ ধরতে চেয়েছেন, লিখেছেন এখানকার জনবিন্যাস, দর্জিশিল্প, সমাজচিত্র: দর্জিমহল্লার ভাষা, খাওয়াদাওয়া, রীতি-রেওয়াজ নিয়ে। ভূমিকা লিখেছেন উর্বী মুখোপাধ্যায়, সম্পাদনায় শুভঙ্কর দেবনাথ। এর মধ্যেই মেটিয়াবুরুজের বহু মানুষের হাতে পৌঁছে গিয়েছে বই।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)