Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

ঝড়ের গতিতে বাইক, ছিটকে মৃত্যু চালকের

ফুটপাতের নীল-সাদা রেলিং আর ব্রিজের স্তম্ভের মধ্যে আটকে রয়েছে মাথা। হলদে সোয়েটার আর নীল জিন্‌স পরা যুবকের দেহের বাকি অংশ গলা থেকে কেটে ঝুলছে রেলিংয়ের গায়ে। পায়ের জুতো ছিটকে গিয়েছে বেশ খানিকটা দূরে। ফুটপাত ঘেঁষা রাস্তায় চাপ চাপ রক্ত।

মর্মান্তিক: জিরাট সেতুর রেলিংয়ের এই অংশেই ধাক্কা লাগে বাইকের। (ইনসেটে) সম্রাট

মর্মান্তিক: জিরাট সেতুর রেলিংয়ের এই অংশেই ধাক্কা লাগে বাইকের। (ইনসেটে) সম্রাট

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০১:০৩
Share: Save:

ফুটপাতের নীল-সাদা রেলিং আর ব্রিজের স্তম্ভের মধ্যে আটকে রয়েছে মাথা। হলদে সোয়েটার আর নীল জিন্‌স পরা যুবকের দেহের বাকি অংশ গলা থেকে কেটে ঝুলছে রেলিংয়ের গায়ে। পায়ের জুতো ছিটকে গিয়েছে বেশ খানিকটা দূরে। ফুটপাত ঘেঁষা রাস্তায় চাপ চাপ রক্ত।

সোমবার রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ আলিপুরের জিরাট সেতুতে উঠে পাড়ার ছেলে সম্রাট চক্রবর্তীর (২৬) এমন পরিণতি দেখে হকচকিয়ে গিয়েছিলেন চেতলা সব্জিবাগানের বাসিন্দারা। তাঁরা দেখেন, দূরে পড়ে রয়েছে সম্রাটের মোটরবাইক। পাশে রাস্তায় পড়ে আছেন অমিত মণ্ডল নামে পাড়ারই আর এক যুবক। স্থানীয় বাসিন্দারাই সঙ্গে সঙ্গে আলিপুর থানায় খবর দেন। পুলিশ গিয়ে সম্রাট এবং অমিতকে উদ্ধার করে দ্রুত এসএসকেএম হাসপাতালে পাঠায়। সেখানে চিকিৎসকেরা সম্রাটকে মৃত ঘোষণা করেন। চিকিৎসার পরে অমিতকে ছেড়ে দেওয়া হলেও মঙ্গলবার সকালে ফের তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছে বলে পরিবার সূত্রের দাবি। পেশায় একটি সংস্থার ‘ডেলিভারি বয়’ অমিত প্রতিবেশীদের জানিয়েছেন, তাঁর মাথায় হেলমেট থাকলেও সম্রাটের ছিল না। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তাঁদের মোটরবাইক প্রথমে জিরাট সেতুর উপরে ফুটপাতে ধাক্কা মারে। গতি প্রচণ্ড বেশি থাকায় বাইক থেকে ছিটকে রেলিংয়ের উপরে গিয়ে পড়েন সম্রাট। এর পরে কিছু মনে নেই তাঁর।

পুলিশ সূত্রের খবর, সোমবার রাতে চেতলার সব্জিবাগানের সরস্বতী প্রতিমার বিসর্জন ছিল। গাড়ি করে প্রতিমা বাবুঘাটে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা হয়। গাড়ির আগে মোটরবাইকে যাচ্ছিলেন সম্রাট এবং অমিত। পুলিশ জানিয়েছে, তীব্র গতিতে চলা বাইকটি আলিপুর চিড়িয়াখানা পেরিয়ে জিরাট সেতুতে উঠেই রেলিং ঘেঁষা ফুটপাতে ধাক্কা মারে। গতি এতই বেশি ছিল যে ধাক্কা মারার পরেও প্রায় ১০ ফুট দূরে গিয়ে বাইকটি থামে। কয়েক মিনিট পরে সম্রাট-অমিতদের পাড়ার অন্য যুবকেরা প্রতিমা-সহ গাড়ি নিয়ে সেতুতে উঠে ওই দৃশ্য দেখেন।

পুলিশ জেনেছে, সম্রাটের নিজের মোটরবাইক আছে। তবে ঘটনার রাতে তাঁরা অমিতের মোটরবাইকে যাচ্ছিলেন। রাত ১১টা নাগাদ অমিত কাজ থেকে ফেরার পরে দু’জনে বেরিয়ে পড়েন। অমিতের ঠাকুরমা কল্পনা মণ্ডল মঙ্গলবার বলেন, ‘‘অমিত নিজের বাইক অন্য কাউকে চালাতে দেয় না। প্রায় জোর করেই সম্রাট চালাতে চাওয়ায় ও রাজি হয়। অমিত হেলমেট পরেছিল। কিন্তু সম্রাট হেলমেট না পরে হাতে ঝুলিয়ে রেখেছিল। হেলমেট পরলে হয়তো ছেলেটা বেঁচে যেত।’’

পাড়ার লোকজন জানাচ্ছেন, বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান সম্রাট পড়াশোনায় মেধাবী ছিলেন। মাধ্যমিকে পাঁচটি লেটার নিয়ে পাশ করেছিলেন। নিউ আলিপুর মাল্টিপারপাস বয়েজ হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের পরে বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নিয়ে স্নাতক হন তিনি। পড়াশোনার পাশাপাশি রীতিমতো ভাল বাস্কেটবল খেলতেন সম্রাট। বাংলার হয়ে প্রতিনিধিত্বও করেছিলেন। আঁকার হাতও ছিল অত্যন্ত ভাল। একমাত্র ছেলের মৃত্যুতে বারবার জ্ঞান হারাচ্ছিলেন মা পুতুল চক্রবর্তী। সম্রাটের বাবা সমরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মী। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের বয়স হচ্ছে। ছেলেই ছিল একমাত্র ভরসা। এখন আমরা কাকে নিয়ে বাঁচব?’’

কান্নায় ভেঙে পড়েছেন মৃত সম্রাটের মা পুতুল চক্রবর্তী। মঙ্গলবার। নিজস্ব চিত্র

একই সঙ্গে সমরেন্দ্রবাবুর অভিযোগ, ‘‘সেতুর ওই জায়গায় আগেও একাধিক দুর্ঘটনা ঘটেছে। আলিপুর চিড়িয়াখানা থেকে জিরাট ব্রিজে ওঠার রাস্তাটা বেশ সরু। তার উপরে ব্রিজের মুখে অন্য একটি রাস্তা (অরফ্যানগঞ্জ রোড) এসে মেশায় পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। ওখানে ২৪ ঘণ্টা পুলিশ থাকা জরুরি।’’ অভিযোগের প্রেক্ষিতে লালবাজারের এক কর্তা বলেন, ‘‘ফুটপাত কেটে জিরাট সেতুর দু’পাশ চওড়া করা হবে। ওখানে ট্র্যাফিক পুলিশ মোতায়েন করার ব্যাপারে ভাবনা-চিন্তা চলছে।’’

সম্রাটের মা পুতুল অবশ্য অভিযোগ করার অবস্থায় নেই। ছেলের পাওয়া ঘরভর্তি মেডেল আর ট্রফির মধ্যে কাঁদতে কাঁদতে শুধু একটাই কথা বলে চলেছেন তিনি, ‘‘এখন কাকে নিয়ে বাঁচব?’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Road Accident Chetla Road Safety
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE