Advertisement
E-Paper

টিফিন-জল খাইয়ে অটিস্টিক কিশোরকে বাড়ি ফেরালেন কন্ডাক্টর

তাঁর এটুকু উপস্থিতবুদ্ধিতেই হারিয়ে যাওয়া অটিস্টিক ছেলেকে ফেরত পেলেন বাবা-মা। সোমবার টানা পাঁচ ঘণ্টা চরম উদ্বেগে কেটেছে তাঁদের।

দীক্ষা ভুঁইয়া ও দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২১ অগস্ট ২০১৯ ০০:২৮
সহায়: চালক ললিত যাদব এবং কন্ডাক্টর কমল লোধ। নিজস্ব চিত্র

সহায়: চালক ললিত যাদব এবং কন্ডাক্টর কমল লোধ। নিজস্ব চিত্র

তিন সন্তানের পিতা তিনি। বেশিরভাগ সময় বাড়ির বাইরে কেটে গেলেও মনের মধ্যে সব সময়ে উঁকি মারে ছেলে-মেয়ের মুখটাই। তাই হঠাৎ করে ব্যারাকপুর বাসস্ট্যান্ডে অভিভাবক ছাড়া স্কুলের পোশাকে একটি বাচ্চাকে দেখে চিন্তাই হয়েছিল তাঁর। পরে কথা বলতে গিয়েও বোঝেন, সে আর পাঁচটা বাচ্চার থেকে আলাদা। বারবার কথা বললেও উত্তর দিচ্ছে না। মুখ নিচু করে বসে রয়েছে। আবার, খুব একটা বিরক্তও হচ্ছে না। শেষে সাহস করে এগিয়ে গিয়ে তার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়েছিলেন তিনি। চেন খুলে বার করেছিলেন স্কুলের ডায়েরি। যদি কোনও ঠিকানা বা ফোন নম্বর মেলে!

তাঁর এটুকু উপস্থিতবুদ্ধিতেই হারিয়ে যাওয়া অটিস্টিক ছেলেকে ফেরত পেলেন বাবা-মা। সোমবার টানা পাঁচ ঘণ্টা চরম উদ্বেগে কেটেছে তাঁদের। শেষে ছেলেকে ফেরত পেয়ে একটাই কথা বলছেন মা, ‘‘ভগবান ওই বাসের কন্ডাক্টরের হাতে ছেলেকে পৌঁছে দিয়েছিলেন। তাই ফেরত পেলাম।’’

সালকিয়ার বাসিন্দা ঘোষ দম্পতির একমাত্র সন্তান বছর চোদ্দোর অভিরূপ ঘোষ (নাম পরিবর্তিত)। সোমবার সকাল সাড়ে আটটায় মায়ের সঙ্গে বেরোয়। গন্তব্য ছিল ইএম বাইপাস সংলগ্ন মনোবিকাশ কেন্দ্র। কিন্তু, সোমবার অভিরূপের ‘মুড’ ছিল অন্য। মা বুঝতে পারেননি। তাই রোজ যে রাস্তা ধরে এত বছর ছেলে আগে আগে হেঁটে যায়, সেই পথ না ধরে সে দৌড় লাগায় অন্য পথে। ছেলেকে দৌড়তে দেখে মা-ও পিছু নেন। কিন্তু ছেলের সঙ্গে পেরে ওঠেননি। কিছু বোঝার আগেই ছেলে বড় রাস্তায় গিয়ে যেন ম্যাজিকের মতো উবে গিয়েছিল! অনেক খোঁজাখুজি করেও না পেয়ে পুলিশের দ্বারস্থ হন ঘোষ দম্পতি।

একটার পর একটা ঘণ্টা কাটতে থাকে। ছেলের খবর মেলেনি। প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা পরে তার খবর আসে অচেনা এক নম্বরের সূত্র ধরে। মা-বাবা জানতে পারেন, অভিরূপ পৌঁছে গিয়েছে ব্যারাকপুরে! তা-ও আবার বাসে চেপে। অবাকই হয়েছিলেন তাঁরা। কারণ বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন হওয়ায় নতুন কোনও কিছু অভিরূপ করে না। তার উপরে সে কোনও দিন বাসেই চড়েনি। তবুও বাসের কন্ডাক্টর পরিচয় দিয়ে কমল লোধ নামে এক ব্যক্তি ফোন করে জানান, কোনও ভাবে অভিরূপ ব্যারাকপুর বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে গিয়েছে। ফের সে ওই রুটেরই সালকিয়াগামী বাসে উঠেছে। আপাতত তাঁর সঙ্গেই সে রয়েছে। সব শুনে অবিশ্বাস করার আর উপায় দেখেননি মধুরিমা ঘোষ (নাম পরিবর্তিত)। তিনি এ দিন বলেন, ‘‘অটিস্টিক হওয়ায় ছেলে চেনা ছকে চলে। অচেনা পথে হাঁটে না। বাইরের লোকের সঙ্গেও খুব একটা কথা বলে না। সে কী ভাবে একা অন্য পথে গিয়ে বাসে উঠল, বুঝতেই পারছি না।’’

অভিরূপকে দেখার পরে ছেলের মতো করে আগলে রেখেছিলেন কমলও। হোটেলে নিয়ে গিয়ে, পাশে বসিয়ে তাঁর ব্যাগ থেকে টিফিন বক্স বার করে খাবার ও জল খাইয়েছেন। মঙ্গলবার কমল জানান, সোমবার বেলা ১১টা নাগাদ ব্যারাকপুর স্ট্যান্ডে বছর তেরো-চোদ্দোর এক স্কুলপড়ুয়াকে একা বাসে উঠতে দেখে তিনি কথা বলতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সে উত্তর না দিয়ে সোজা বাসে উঠে বসে পড়ে। আচরণ একটু অস্বাভাবিক ঠেকায় কমলের মনে হয়েছিল, বাচ্চাটির সমস্যা রয়েছে। একই সঙ্গে ছেলেটিকে দেখে মায়াও হয়েছিল তাঁর। কমল বলেন, ‘‘আমারও ছেলে-মেয়ে রয়েছে। কোনও বাচ্চাকে একা রাস্তায় দেখলে একটু ভয়ই লাগে। তাই এগিয়ে গিয়েছিলাম। দেখলাম, খুব শান্ত বাচ্চা।’’ কমল আরও জানালেন, ছেলেটিকে দেখার পরে যখন খেতে যাবেন বলে ঠিক করছেন তখন তাকে সঙ্গে আসার জন্য বলেন। অভিরূপ চুপচাপ কমলের সঙ্গে হোটেলে এসে ঢোকে। আর তখনই কমলের মনে হয়, বাচ্চাটিকে বাবা-মায়ের হাতে তুলে দিতেই হবে। সেই মতো সালকিয়াগামী বাসে চাপিয়েই দুপুর দেড়টা নাগাদ চালক ললিত যাদব ও কমল তাকে নিয়ে বাড়ির কাছে পৌঁছন।

আর অভিরূপের মা-বাবা? ছেলেকে এ ভাবে যে এক বাস কন্ডাক্টর ফেরত দিয়ে যেতে পারেন, ভাবতেই পারেননি তাঁরা। কমল তাঁদের কাছে এখন ‘ঈশ্বরের প্রতিনিধি!’

Barrackpore Autism Autistic
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy