Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
টিভি-নকলে মৃত্যু কিশোরের

ছোটদের দুনিয়ায় বাড়তি নজরদারির আর্জি

টিভি-তে ডব্লিউডব্লিউই (ওয়ার্ল্ড রেস্টলিং এন্টারটেনমেন্ট) মানেই আর রোখা যেত না অগ্নিবেশকে। সে দেখবেই। কোন কুস্তিগির কী ভাবে প্রতিদ্বন্দ্বীর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, দু’পায়ের কাঁচি-ফাঁসে কী ভাবে তাকে ঘায়েল করছে, এক জনের বিরাশি সিক্কার গুঁতো আর এক জন কী করে সামলাচ্ছে টিভি-র পর্দায় চোখ রেখে কার্যত গিলত সে। আর পরে সেই প্যাঁচপয়জার বন্ধুদের দেখিয়ে বাহবাও পেত। আর এতেই বাড়ছিল কুস্তি দেখার উৎসাহ।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ১৪ মার্চ ২০১৫ ০৩:৫৩
Share: Save:

টিভি-তে ডব্লিউডব্লিউই (ওয়ার্ল্ড রেস্টলিং এন্টারটেনমেন্ট) মানেই আর রোখা যেত না অগ্নিবেশকে। সে দেখবেই। কোন কুস্তিগির কী ভাবে প্রতিদ্বন্দ্বীর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, দু’পায়ের কাঁচি-ফাঁসে কী ভাবে তাকে ঘায়েল করছে, এক জনের বিরাশি সিক্কার গুঁতো আর এক জন কী করে সামলাচ্ছে টিভি-র পর্দায় চোখ রেখে কার্যত গিলত সে। আর পরে সেই প্যাঁচপয়জার বন্ধুদের দেখিয়ে বাহবাও পেত। আর এতেই বাড়ছিল কুস্তি দেখার উৎসাহ।

কিন্তু দুঃস্বপ্নেও কেউ ভাবেননি নামী ইংরেজি-মাধ্যম স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র পনেরো বছরের কিশোর অগ্নিবেশ দত্তকে নিজের জীবন দিয়ে সেই উৎসাহের দাম দিতে হবে!

সল্টলেকে নিজের বাড়িতে কুস্তির প্যাঁচ নকল করতে গিয়ে গলায় দড়ির ফাঁস আটকে বুধবার রাতে অগ্নিবেশের মৃত্যু হয়েছে বলে মনে করছে পুলিশ। মা তখন বাথরুমে। টের পাননি কিছুই। বাড়ি ফিরে বাবা-ই প্রথম দেখতে পান, গ্রিলের সঙ্গে বাঁধা দড়ির ফাঁস গলায় আটকে ঝুলছে অগ্নিবেশ। হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন চিকিৎসকেরা।

ঘটনার আকস্মিকতায় কথা বলার ক্ষমতা হারিয়েছেন বাবা-মা। সল্টলেকের যে স্কুলে পড়ত অগ্নিবেশ, সেখানকার শিক্ষক-ছাত্র-অভিভাবকেরা স্তম্ভিত। জনে জনে অভিভাবকদের মোবাইলে মেসেজ পাঠিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষের সনির্বন্ধ অনুরোধ ছোটরা টিভি-তে কী দেখছে, দয়া করে সে দিকে নজর রাখুন। সোশ্যাল মিডিয়ায় তারা কী করছে নজর রাখুন সে দিকেও। কারণ, তাদের অপরিণত মনে অনেক অনুষ্ঠানেরই বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।

এতেই সমস্যার সমাধান হবে, মনোবিদ বা সমাজতাত্ত্বিকেরা অবশ্য তা মনে করছেন না। টিভিতে রামায়ণ-মহাভারতের যুদ্ধ দেখে বহু শিশু খেলনা তির-ধনুক নিয়ে খেলতে গিয়ে চোখে খোঁচা খেয়েছে। ঠান্ডা পানীয়ের বিজ্ঞাপনে এক বীরপুঙ্গব পায়ে দড়ি বেঁধে খাড়া পাহাড়ের ঢাল থেকে লাফিয়ে পড়ছেন দেখে অনেক শিশুও বাড়ির ছাদে উঠে তা নকল করতে গিয়েছে। কেউ ভেবেছে বাড়ির জানলা থেকে লাফিয়ে পড়লে শক্তিমান এসে ঠিক বাঁচাবে। অথচ বাস্তবে তাদের অনেককেই প্রাণ দিয়ে এ সব চমকপ্রদ কেরামতির খেসারত দিতে হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সমস্যাটা আসলে পরিবর্তিত সামাজিক কাঠামোয়। ছোটরা এখন বহু ক্ষেত্রেই নিঃসঙ্গ। টিভি, মোবাইল আর কম্পিউটারই এখন বন্ধু তাদের। ওদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ভাগ নিতে পারা, তাদের মনের কথা বন্ধুর মতো শোনার লোক এই ব্যস্ততার যুগে বড়ই দুর্লভ। সমস্যার বীজটা সম্ভবত এর মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে।

মনোবিদ মোনালিসা ঘোষের ব্যাখ্যা, ৬ থেকে ১০ বছরের বাচ্চারা তাড়াতাড়ি কল্পনার রাজ্যে চলে যায়। কিন্তু নবম শ্রেণির এক কিশোরের এ ভাবে অবাস্তবের দুনিয়ায় হারিয়ে যাওয়া এবং তার জেরে নিজের গলায় ফাঁস লাগিয়ে ফেলাটা খুব স্বাভাবিক নয়। হতে পারে, বাস্তবের কিছু ভাল না-লাগা থেকে পালাতে গিয়ে সে কল্পনায় ডুব দিয়ে সেটাকেই বাস্তব হিসাবে দেখেছে। মোনালিসার কথায়, “তার মানে ধরে নিতে হবে, বাস্তবে কোথাও একটা তার মানসিক সঙ্কট রয়েছে, অভিভাবকেরা হয়তো সে দিকে তেমন নজর দেননি।”

মনোবিদ অমিত চক্রবর্তী আবার মনে করেন, একটা ১৫ বছরের ছেলের জেনে-বুঝে নিজের ক্ষতি করার কথা নয়। সে নিশ্চয়ই আগেও কুস্তির প্যাঁচ নকল করে বন্ধুদের ও অভিভাবকদের দেখিয়েছে। তখন সম্ভবত সে বাহবাই পেয়েছে। আর তাতেই তার সাহস এত বেড়ে গিয়েছে যে, এমন দুঃসাহসিক কিছু নকল করতেও দু’বার ভাবেনি সে। তাঁর কথায়, “অল্পবয়সিরা টেলিভিশন দেখতেই পারে। কিন্তু কী দেখছে, সে দিকে বাবা-মাকে মনোযোগী হতে হবে।” অমিতবাবু মনে করেন, “আমরা বেশির ভাগই যৌনতা নিয়ে বেশ স্পর্শকাতর। তাই সেই ধরনের অনুষ্ঠান দেখতে বাচ্চাদের নিষেধ করি। কিন্তু টিভির পর্দায় হিংসাত্মক অনুষ্ঠান দেখার ব্যাপারে তেমন আপত্তি করি না। অথচ এর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।”

সমাজতাত্ত্বিক প্রদীপ বসুর মতে, যৌথ পরিবার ভেঙেছে। কর্মব্যস্ততা বেড়েছে। সামাজিক মেলামেশা আজকাল প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে। বাবা-মা চাকরি করেন। বাচ্চা প্রায় সারা দিন বাড়িতে একা। খেলার সঙ্গীর জায়গা নিয়েছে কম্পিউটার, মোবাইল আর টিভি। কিন্তু এগুলো যে কল্পনার জগৎ, বাস্তব থেকে বহু দূর সেই শিক্ষাটা দেওয়ার মতোও কাউকে পায় না তারা। আর তাতেই বিপদ ঘনাচ্ছে।

মডার্ন হাইস্কুলের অধ্যক্ষা কাবেরী দত্ত বা ভারতীয় বিদ্যাভবনের অধ্যক্ষা অনিন্দিতা চট্টোপাধ্যায়ের মতো অনেকেই এই ঘটনায় উদ্বিগ্ন। স্কুলের অ্যাসেম্বলি হলে, ক্লাসে-ক্লাসে গিয়ে ছাত্রছাত্রীদের এ ব্যাপারে সচেতন করার কথা ভাবছেন তাঁরা। জোর দিতে চাইছেন খেলাধুলোর উপরেও। কারণ মনোবিদদের মতে, শিশুমনের বিকাশের ক্ষেত্রে খেলাধুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। যে সব শিশু প্রতি দিন সঙ্গীদের সঙ্গে খেলাধুলো করে, টিভির প্রতি তাদের আকর্ষণ অনেক কম।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

wwe
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE