E-Paper

হেলে পড়া বাড়িতেই রয়ে গেল ব্যাটম্যান, মানছে না শিশুমন

বাড়ি ভাঙার চেয়েও জোরে তার বুকে তখন ধাক্কা খাচ্ছে প্রিয় ব্যাটম্যানের সঙ্গে চিরতরে বিচ্ছেদের আশঙ্কা।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০২৫ ০৫:৫৯
বিপত্তি: চলছে হেলে পড়া বাড়ি ভাঙার কাজ। বুধবার, নেতাজিনগরে।

বিপত্তি: চলছে হেলে পড়া বাড়ি ভাঙার কাজ। বুধবার, নেতাজিনগরে। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

দুপুর গড়িয়ে তখন প্রায় বিকেল। পুরসভার যান্ত্রিক মইয়ে উঠে বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর কর্মীরা হাতুড়ি মেরে ভাঙছেন নেতাজিনগরের বিদ্যাসাগর কলোনির হেলে পড়া বাড়িটির কার্নিশ। জানলা দিয়ে ভিতরে তাকালে চোখে পড়ছে ঘরের নানা আসবাব। চার পাশ গার্ডরেল দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। উদ্বিগ্ন মুখে সে দিকে তাকিয়ে বাসিন্দাদের কেউ কেউ। প্রয়োজনীয় ও দামি জিনিস কতটা ফেরত পাবেন, তা নিয়েই কপালে ভাঁজ তাঁদের। তার মধ্যেই আচমকা কেঁদে উঠল বছর চারেকের কিয়ান পাল। মধ্য কলকাতার একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের নার্সারির ওই পড়ুয়ার কয়েকটি প্রিয় খেলনা ও ব্যাটম্যান রয়ে গিয়েছে হেলে পড়া বাড়িটির উপরের তলার ফ্ল্যাটে। বাবা সন্দীপ পাল ছেলেকে নতুন খেলনা কিনে দেওয়ার ভরসা দিলেও শিশুমন তা মানতে নারাজ। বাড়ি ভাঙার চেয়েও জোরে তার বুকে তখন ধাক্কা খাচ্ছে প্রিয় ব্যাটম্যানের সঙ্গে চিরতরে বিচ্ছেদের আশঙ্কা।

বিয়ের পরে এই বহুতলে ফ্ল্যাট কিনেই নতুন সংসার পেতেছিলেন সন্দীপ ও তাঁর স্ত্রী অর্পিতা। পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের সন্তান, ছোট্ট কিয়ানকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন একই বহুতলের বাসিন্দা রূপা চৌধুরী। ছেলেবেলায় বাবাকে হারানো রূপার কাছে তাঁর একটা ছাড়া আর কোনও ছবি নেই। বাবার সেই ছবিটা উদ্ধার করে এনে দিতে অনুরোধ করেছিলেন বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর কর্মীদের। তাঁরা আশ্বাস দিলেও মন মানছিল না রূপার। অন্য বাসিন্দাদের কেউ কেউ তখনও কী ভাবে দরকারি কাগজ, গয়না-ল্যাপটপ-টিভি বাঁচানো যাবে, তা নিয়ে কথা বলছেন পুরকর্মীদের সঙ্গে।

বিদ্যাসাগর কলোনির এই বহুতলটি পাশের যে বাড়ির উপরে হেলে পড়েছে, সেটির বাসিন্দা সমীর দত্ত জানালেন, এক সময়ে সেখানে ডোবা ছিল। স্থানীয় সূত্রের খবর, দু’কাঠা জমির প্লটে একটি ছোট বাড়ি ভেঙে আবর্জনার স্তূপের উপরে গড়ে উঠেছিল বহুতলটি। চারতলা বাড়িটির বাসিন্দা আটটি পরিবারের প্রায় সকলেই নগদে ফ্ল্যাট কিনেছিলেন। নিজের জন্য দু’টি ফ্ল্যাট রেখে বাকি ছ’টি ফ্ল্যাট বিক্রি করেন প্রমোটার। আর ওই দু’টি ফ্ল্যাট তিনি ভাড়া দেন।

বছর চারেক আগে বাড়িটি আচমকা ডান দিকে হেলে যায়। তার পর থেকেই বাসিন্দাদের সঙ্গে সমস্যা শুরু হয় প্রোমোটার সুভাষ রায়ের। মাঝে তিনি ফ্ল্যাট ঠিক করতে বাসিন্দাদের থেকে এক লক্ষ টাকা করে দাবি করেন। বাসিন্দারা তা দিতে রাজি হননি। কয়েক মাস আগে ইঞ্জিনিয়ার নিয়ে প্রোমোটার নিজেই ওই বাড়ি পরীক্ষা করান বলে দাবি বাসিন্দাদের একাংশের। হেলে পড়ার সমস্যা ভবিষ্যতে মারাত্মক চেহারা নিতে পারে, তা আঁচ করে তিনি নিজেই বাড়িটি মেরামতের প্রস্তাব দেন। গত ডিসেম্বরে হরিয়ানার একটি সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করে তাতে বাসিন্দাদের শামিল করেন। মোটা টাকা নিয়ে ওই সংস্থা অন্তত ২০ বছরের জন্য বাড়ির সমস্যা মেটানোর আশ্বাস দেয়। তার ভিত্তিতেই কাজ শুরু হয়েছিল বলে খবর। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি বাসিন্দারা ভাড়া বাড়িতে উঠে যান। তবে অনেকেই জিনিসপত্র ফ্ল্যাটে রেখে যান।

এ দিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক দীপঙ্কর চক্রবর্তী। কী ভাবে পিছনের ও বাঁ পাশের বাড়ির ক্ষতি এড়িয়ে বিপজ্জনক বাড়িটি ভাঙা যাবে, তা পুরকর্মী এবং আধিকারিকদের বুঝিয়ে দেন। সেই মতোই রাত পর্যন্ত বাড়ি ভাঙার কাজ চলেছে। স্থানীয় পুরপ্রতিনিধি মিতালি বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘ওই বহুতলের মেরামতির বিষয়ে বিন্দুবিসর্গ জানা ছিল না। প্রোমোটারও কিছুই জানাননি। আপাতত পুরসভার নির্দেশে বাড়ি ভাঙার কাজ চলবে। অভিযুক্তদের গ্রেফতারির পরে পুর কর্তৃপক্ষ ঠিক করবেন, কী ভাবে আবাসিকদের সমস্যার সমাধান করা যাবে।’’

এই ঘটনায় মঙ্গলবারই প্রোমোটার, ফ্ল্যাটমালিক ও হরিয়ানার সংস্থাটির বিরুদ্ধে মামলা করে লালবাজার। যদিও ঘটনার পর থেকে নিখোঁজ অভিযুক্ত প্রোমোটার। মঙ্গলবার রাতে শেষ বার তাঁর ফোন খোলা ছিল বলে পুলিশ সূত্রের খবর। তাঁর শেষ টাওয়ার লোকেশন ছিল দুর্গাপুরের কাছাকাছি। হরিয়ানার সংস্থাটিরও কারও হদিস পায়নি পুলিশ। তাদের নোটিস দিয়ে ডাকার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Building Collapse Batman

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy