চিনা মাঞ্জার খেল। সোমবার, হাওড়ায়। — দীপঙ্কর মজুমদার
বাস্তবই হোক বা টেলিভিশনের পর্দা, মাঞ্জা সুতো ভিলেনই!
বহুতলের ছাদে নৈশ পার্টিতে আচমকাই গলা চেপে বসে পড়লেন এক জন। বাকিরা দেখলেন, গলা বেয়ে অঝোরে নামছে রক্তের ধারা। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগেই নিথর হয়ে গেল দেহ। ফরেন্সিক রিপোর্টে জানা গেল, ভাঙা গ্লাস নয়, কাচের গুঁড়ো মাখানো কড়া মাঞ্জা সুতো দিয়ে গলা কাটা হয়েছে ওই ব্যক্তির। এর পরে পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে দুর্ঘটনায় মৃত এক বালকের বাবার প্রতিহিংসার কাহিনি।
এ তো না হয় হিন্দি টেলি-সিরিয়ালের গল্প। তবে কড়া মাঞ্জা সুতো যে খুনের হাতিয়ার হতে পারে, তা শুধু গল্পের কথা নয়। ইতিমধ্যেই বাস্তবেও বেশ কিছু মৃত্যু হয়েছে ওই সুতোর ফাঁসে। রবিবার পরমা উড়ালপুলেও তেমনই একটি দুর্ঘটনা থেকে অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচেছেন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র সৌপর্ণ দাশ। উড়ালপুল দিয়ে মোটরবাইকে যাওয়ার সময়ে চিনে মাঞ্জা জড়িয়ে আহত হন তিনি।
গত এক বছরে উত্তরপ্রদেশ, গুজরাতে একাধিক মৃত্যুর জন্য এই মাঞ্জা সুতোই দায়ী বলে জানা গিয়েছে। এই সুতোর ধারে মারা গিয়েছে বহু পাখিও। সে বিষয়ে চিন্তা প্রকাশ করে জাতীয় পরিবেশ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিল পরিবেশ নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘পেটা’। গত ১৪ ডিসেম্বর গোটা দেশে চিনা মাঞ্জা তৈরি, বিক্রি, কেনা ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করে দেয় জাতীয় পরিবেশ আদালতের চেয়ারম্যান, বিচারপতি স্বতন্ত্র কুমারের ডিভিশন বেঞ্চ। এই মাসে সুপ্রিম কোর্ট ওই নির্দেশ বহাল রেখেছে। তার পরেও চিনা মাঞ্জা ব্যবহারে বিরাম নেই। ওই ছাত্রকে কেউ ইচ্ছাকৃত ক্ষতি করেছেন, এমনটা জানা যায়নি। ঘুড়ির মাঞ্জা সুতো কোনও ভাবে ওই উড়ালপুলে এসে পড়ায় দুর্ঘটনা ঘটেছে বলেই মনে করছে পুলিশ। কিন্তু ওই দুর্ঘটনাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, মহানগরের পথঘাটে ঘুড়ির মাঞ্জা সুতোতেও জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা ষোলো আনা।
কয়েক বছর ধরে বাজারে আমদানি হয়েছে সিন্থেটিক মাঞ্জা সুতোর। চলতি কথায় অবশ্য একে চিনা মাঞ্জা বলেই লোকে চেনে। মারাত্মক ধারালো এই সুতো শুধু ঘুড়িই কাটে না, কেটে দিতে পারে মানুষের গলাও। পরমা উড়ালপুলে সৌপর্ণ আহত হওয়ার আগের দিন, শনিবারই মকর সংক্রান্তিতে ওই চিনা মাঞ্জা সুতোয় গলা কেটে আমদাবাদে এক মহিলার মৃত্যু হয়েছে। পরিবেশকর্মী এবং বহু সাধারণ মানুষের অভিযোগ, অনেক রাজ্যেই রমরমিয়ে বিকোচ্ছে এই চিনা মাঞ্জা। প্রধানমন্ত্রীর রাজ্য গুজরাতেও যে এই নিষিদ্ধ, বিপজ্জনক বস্তুর কারবার বন্ধ হয়নি, তার প্রমাণ শনিবার আমদাবাদের ঘটনা।
কিছু দিন আগে হাওড়ার পাঁচলা এলাকার বাসিন্দা এক যুবক জাতীয় সড়ক দিয়ে মোটরবাইক চ়ড়ে যাওয়ার সময়েও চিনা মাঞ্জা সুতোয় আহত হয়েছিলেন। পরিবেশকর্মীরা বলছেন, শহর ও শহরতলির বহু এলাকায় বিশ্বকর্মা পুজোর সময়ে অনেক পাখি মারা গিয়েছে বা আহত হয়েছে এই ভয়ঙ্কর সুতোর ফাঁসে।
পুলিশ ও পরিবেশকর্মীদের একাংশের খবর অনুযায়ী, ই এম বাইপাস লাগোয়া কয়েকটি তল্লাটে প্রকাশ্যেই চিনা মাঞ্জার পসরা সাজিয়ে বসেন দোকানিরা। সেই সুতো নিয়েই ঘুড়ি কাটাকাটির খেলায় মাতেন অনেকে। পুলিশের অনুমান, মকর সংক্রান্তি উপলক্ষে পরমা উড়ালপুল লাগোয়া কয়েকটি তল্লাটে শনি ও রবিবার দেদার ঘুড়ি উড়েছে। তাদের কোনও একটি কেটে গিয়ে বা গোঁত্তা খেয়ে পড়ে এবং তার সুতো আড়াআড়ি ভাবে উড়ালপুলে আটকে ছিল। মোটরবাইক চালিয়ে যাওয়ার সময়ে ওই সুতোই সৌপর্ণের গলায় লাগে বলে মনে করছে পুলিশ।
ওই এলাকার ট্র্যাফিকের দায়িত্বে থাকা এক অফিসার বলছেন, ‘‘ঘুড়ি ওড়ানো আটকানো সম্ভব নয়। কিন্তু এই দুর্ঘটনা বড় বিপদের ইঙ্গিত দিল।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy