Advertisement
E-Paper

ফের ধুন্ধুমার যাদবপুরে, ছবি ঘিরে পড়ুয়া-বিজেপি হাতাহাতি

উত্তেজনার রসদ মজুতই ছিল। একটি সিনেমার আয়োজন এবং শেষ লগ্নে হল-এর বুকিং বাতিল হওয়া নিয়ে। সেই সূত্র ধরেই শুক্রবার রাতে ফের রণক্ষেত্রের আকার নিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৭ মে ২০১৬ ০৩:৪১
বিজেপি কর্মী-সমর্থক ও পড়ুয়াদের মধ্যে অশান্তি থামানোর চেষ্টা করছেন উপাচার্য সুরঞ্জন দাস। শুক্রবার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে।

বিজেপি কর্মী-সমর্থক ও পড়ুয়াদের মধ্যে অশান্তি থামানোর চেষ্টা করছেন উপাচার্য সুরঞ্জন দাস। শুক্রবার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে।

উত্তেজনার রসদ মজুতই ছিল। একটি সিনেমার আয়োজন এবং শেষ লগ্নে হল-এর বুকিং বাতিল হওয়া নিয়ে। সেই সূত্র ধরেই শুক্রবার রাতে ফের রণক্ষেত্রের আকার নিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়।

এক দিকে পড়ুয়ারা এবং অন্য দিকে এবিভিপি-আরএসএস-বিজেপি কর্মীদের মধ্যে তুমুল বাদানুবাদ এবং হাতাহাতির উত্তেজিত আবহে উপাচার্য সুরঞ্জন দাস নিজে ট্যাক্সি ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটে যান। চলে আসেন বিজেপি নেত্রী রূপা গঙ্গোপাধ্যায়ও। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে তখন ধুন্ধুমার চলছে। এক নম্বর গেটের বাইরে গলা ফাটাচ্ছেন বিজেপি কর্মীরা। ভিতরে পড়ুয়াদের ঢল। উভয়েই মারমুখী।

কেন? ক্যাম্পাসে ছাত্রীদের শ্লীলতাহানির অভিযোগকে কেন্দ্র করে এবিভিপি-র চার বহিরাগত সদস্যকে পড়ুয়ারা আটকে রেখেছিলেন। ওই চার জনকে মারধর করা হয় বলেও অভিযোগ। তাঁদের ছাড়াতেই জড়ো হয়েছিলেন রূপারা। উপাচার্য দু’পক্ষের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বিজেপি কর্মীদের আশ্বস্ত করেন যে, আটক চার জনকে ছেড়ে দেওয়া হবে। একই সঙ্গে পড়ুয়াদেরও এই বলে আশ্বস্ত করেন যে, ওই চার জনের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে শ্লীলতাহানির অভিযোগ দায়ের করবেন কর্তৃপক্ষ। পরে সেই এফআইআর করাও হয়েছে যাদবপুর থানায়। পুলিশ গিয়ে তার পর বিজেপি কর্মী-সমর্থকদের সরিয়ে দেয়। যদিও যাদবপুর থানা চত্বরে অনেক রাত অবধি ভিড় করে থাকেন পড়ুয়ারা। অভিযুক্তদের গ্রেফতার না-করে ছেড়ে কেন রাখা হল, তাই নিয়ে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন তাঁরা।

এত কাণ্ডের সূত্রপাত কী ভাবে? বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর, ‘থিঙ্ক ইন্ডিয়া’ নামে একটি সংগঠনের ব্যানারে এবিভিপি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে ত্রিগুণা সেন অডিটোরিয়ামটি ভাড়া নিয়েছিল ‘বুদ্ধ ইন আ ট্রাফিক জ্যাম’ সিনেমাটি দেখানোর জন্য। ‘হেট স্টোরি’-খ্যাত পরিচালকের এই নতুন ছবিটিতে উগ্র বামপন্থার বিরুদ্ধে কথা বলা হয়েছে বলে একাংশের দাবি। এর আগে ছবিটি জেএনইউ-তে দেখানো হয়েছিল। এ দিন যাদবপুরে দেখানোর কথা ছিল। কিন্তু বৃহস্পতিবার বিকেলে হল কর্তৃপক্ষ, অর্থাৎ যাদবপুর অ্যালামনি অ্যাসোসিয়েশন হঠাৎই তাদের বুকিং বাতিল করে দেয়। বাতিলের কারণ হিসেবে নির্বাচন-বিধির কথা জানিয়ে অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক শিপ্রা পাত্র একটি চিঠি দেন। সে খবর শুক্রবার সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। যদিও নির্বাচনবিধির ঠিক কোন সূত্রে হলের বুকিং বাতিল হল, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

শুক্রবার ‘থিঙ্ক ইন্ডিয়া’র তরফে ঘোষণা করা হয়, তাঁরা এ দিন বিকেলে ক্যাম্পাসের মাঠে ছবি দেখাবেন। তার আগে যাদবপুর ৮বি মোড় থেকে এবিভিপি এবং বিজেপি সমর্থকেরা হল বুকিং বাতিল করে দেওয়ার প্রতিবাদে একটি মিছিল করবেন। সেটি ক্যাম্পাসের ভিতরে ঢুকবে না।

পড়ুয়াদের মধ্যে একটি অংশের কাছে অবশ্য এই ছবিটি ঘিরে প্রতিবাদের জমি তৈরি হয়েই ছিল। পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রী এবং অভিনেতা অনুপম খের ক্যাম্পাসে এলে রোহিত ভেমুলা এবং জেএনইউ-এর ঘটনায় তাঁদের ভূমিকার প্রতিবাদে কালো পতাকা দেখানো হবে বলে ঠিক ছিল। ছাত্র সংসদ ফেটসু-র তরফে স্বর্ণেন্দু বর্মণ বৃহস্পতিবার রাতেই দাবি করেছিলেন, ‘‘আমরা সিনেমা দেখানো বন্ধ করা নিয়ে উপাচার্যের কাছে কোনও আবেদনও করিনি। বাধাও দেব না। কিন্তু যদি অনুপম খের এবং বিবেক অগ্নিহোত্রী আসেন, আমরা কালো পতাকা দেখিয়ে প্রতিবাদ জানাব।’’ একই কথা বলেছিলেন আফসু-র শৌনক মুখোপাধ্যায়ও।

এ দিন বিকেল পাঁচটায় বিবেক ক্যাম্পাসে ঢোকেন। তখন পড়ুয়ারা কালো পতাকা দেখিয়ে তাঁর গাড়ি ঘিরে ধরেন। দু’পক্ষের মধ্যে আবহাওয়া উত্তপ্ত হতে শুরু করেছিল তখনই। তবে এর পরও পরিচালক প্রবল ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনির মধ্যে গাড়ি থেকে নেমে মাঠে পৌঁছন এবং সিনেমা শুরু হয়। বিকেল সাড়ে ৫টা নাগাদ এবিভিপি-র রাজ্য সভাপতি সুবীর হালদার, সহসভাপতি অভিজিৎ বিশ্বাস-সহ স্থানীয় বিজেপি এবং আরএসএস সমর্থকদের ক্যাম্পাসে ঢুকতে দেখা যায়। তখনই তাঁদের সঙ্গে পড়ুয়াদের দফায় দফায় বচসা বাধে এবং তা হাতাহাতিতে পৌঁছয়।

সিনেমাটি কিন্তু চলছিল। আবার তার পাশাপাশি ক্যাম্পাসের ভিতরেই অন্য একটি জায়গায় ‘মুজফ্ফনগর বাকি হ্যায়’ বলে একটি ছবি দেখাতে শুরু করেছিলেন পড়ুয়ারা। এর মধ্যে রাত আটটা নাগাদ যুগ্ম-রেজিস্ট্রার পার্থপ্রতিম লাহি়ড়ি ঘটনাস্থলে এসে দু’টি সিনেমাই বন্ধ করার নির্দেশ দেন বলে বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর। তিনি ‘দু’পক্ষকেই জানিয়ে দেন, সিনেমা দেখানোর কোনও অনুমতি কর্তৃপক্ষ দেননি। তাই সিনেমা বন্ধ করতে হবে। এর পরই সিনেমা বন্ধ করা এবং না করা নিয়ে ফের গোলমালে জড়িয়ে পড়ে দু’পক্ষ। অভিযোগ, এরই মাঝে ‘থিঙ্ক ইন্ডিয়া’র কয়েক জন ছাত্রীদের শ্লীলতাহানি করলে তাদের চার সদস্যকে পড়ুয়ারা ধরে ফেলেন এবং মারধর করেন। ‘আটক’ সমর্থকদের ছাড়াতে রাতে যাদবপুর থানা ঘেরাও করতে চলে আসেন রূপা গঙ্গোপাধ্যায়। ছিলেন বিজেপি কাউন্সিলর এবং তাঁর স্বামীও।

উপাচার্য এসে দু’পক্ষের সঙ্গে কথা বলে রফাসূত্রের পথ দেখান। যাদবপুর থানা রাতে জানিয়েছে, পৌনে ১১টা নাগাদ পুলিশি পাহারায় পার্থপ্রতিম চক্রবর্তী, কৌশিক চৌধুরী, সন্দীপ দাস এবং তন্ময় বসাক নামে ওই চার জনকে ক্যাম্পাস থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এবিভিপি-র দাবি, ওই চার জনকে পড়ুয়ারা মারধর করায় তাঁদের হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। তাঁরা এ নিয়ে পুলিশে অভিযোগও দায়ের করেছেন। উল্টো দিকে ওই চার জনের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি ছাত্রীদের তরফেও আলাদা করে শ্লীলতাহানির অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।

সামগ্রিক ভাবে এ দিনের ঘটনায় অত্যন্ত ক্ষুব্ধ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। উপাচার্য স্পষ্ট ভাষায় জানান যে, ত্রিগুণা সেন হলটি ক্যাম্পাসের ভিতরে হলেও তার সঙ্গে কর্তৃপক্ষের কোনও যোগ নেই। হল বুকিং বা বাতিল, পুরোটাই অ্যালামনি অ্যাসোসিয়েশন দেখভাল করে। ফলে এ দিনের ঘটনার দায় তাদেরই নিতে হবে। মাঠে ছবি দেখানোর জন্য কোনও পক্ষকেই অনুমতি দেওয়া হয়নি বলেও জানান সুরঞ্জনবাবু। অ্যালামনি অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গেও যোগাযোগের চেষ্টা হয়েছিল। তাঁদের অফিস বন্ধ ছিল এ দিন। সম্পাদক শিপ্রা পাত্র ফোন ধরেননি। এর পর থেকে ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠান করার ক্ষেত্রে বহিরাগত সংগঠনের উপরে রাশ টানার কথা ভাবছেন কর্তৃপক্ষ।

ঘটনা হল, শ্লীলতাহানির অভিযোগকে কেন্দ্র করেই এর আগে ‘হোক কলরব’-এ উত্তাল হয়েছিল যাদবপুর। আবার বিনা অনুমতিতে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানকে ঘিরেই সম্প্রতি তোলপাড় হচ্ছে জেএনইউ। জেএনইউ-এর ঘটনার প্রতিবাদকে ঘিরে যাদবপুরের আন্দোলনে এর আগে একাধিক বারই বি়জেপি-আরএসএসের সঙ্গে অশান্তির উপক্রম হয়েছে। কিছু দিন আগে যাদবপুরের পড়ুয়াদের দেশদ্রোহী বলে দাবি করে যাদবপুর থানার সামনে অবস্থান করেছিল বিজেপি। রূপা তাতেও অংশ নিয়েছিলেন। এ দিনের ঘটনাটিও তাই বিচ্ছিন্ন নয় বলেই মনে করছেন অনেকে। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য আনন্দদেব মুখোপাধ্যায় এর পিছনে পরিকল্পিত আক্রমণের ছায়া দেখছেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের দাপাদাপি নিয়ে উদ্বিগ্ন। তাদের মধ্যে অনেকে নেশাগ্রস্ত ছিল বলেও বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর। স্বয়ং উপাচার্যকে রীতিমতো ধাক্কাধাক্কির মধ্যে পড়তে হয় এ দিন। গোটা ঘটনার প্রতিবাদে যাদবপুরের পড়ুয়ারা শনিবার মিছিলের ডাক দিয়েছেন।

ছবি: শশাঙ্ক মণ্ডল।

jadavpur university film film screening
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy