Advertisement
০২ মে ২০২৪
Harassment

নেশামুক্তি কেন্দ্রে রডের ঘা! ছেলের ‘নরক-যন্ত্রণা’র অভিযোগ দায়ের

গত বৃহস্পতিবার, দু’মাস পরে ছেলেকে দেখতে গেলে মাকে ধরে কেঁদে ফেলেন যুবক। তখনই তিনি মাকে জানান মারধরের কথা। যুবকের অবস্থা দেখে পরিজনেরা তাঁকে বাইপাসের ধারের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান।

An image of the injury

আক্রান্ত: হাতের আঘাত দেখাচ্ছেন ওই যুবক। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।

নীলোৎপল বিশ্বাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ মার্চ ২০২৪ ০৭:১১
Share: Save:

চোখের নীচে কালশিটে। বাঁ হাতের বেশ খানিকটা জায়গায় রক্ত জমাট বাঁধা। অবস্থা এমন যে, ওই হাত নাড়ানোর ক্ষমতা নেই। ডান হাতেরও একাধিক জায়গায় কাটা দাগ। কড়ে আঙুল ফুলে পুঁজ গড়াচ্ছে।

ভর্তি করানোর দেড় মাসের মাথায় গত বৃহস্পতিবার দমদম পার্কের একটি নেশামুক্তি কেন্দ্র থেকে ছেলেকে এমনই অবস্থায় উদ্ধার করলেন তাঁর বাবা-মা। এর পরেই ‘প্রতিশ্রুতি ফাউন্ডেশন’ নামে ওই কেন্দ্রের বিরুদ্ধে ছেলেকে মারধর এবং নির্যাতনের লিখিত অভিযোগ নাগেরবাজার থানায় দায়ের করেন তাঁরা। তাঁদের দাবি, ওই কেন্দ্রে তাঁদের ৩৫ বছরের ছেলেকে মারধর করা হত। রড দিয়ে মেরে হাতের আঙুল ভেঙে দেওয়া হয়েছে। শরীরে মারধরের একাধিক চিহ্ন রয়েছে। অভিযোগ, তার পরেও যুবকের চিকিৎসা করানো হয়নি। জানানো হয়নি পরিবারকেও। উল্টে যুবককে এই বলে ভয় দেখানো হত যে, বন্ড সই করে দিয়ে গিয়েছে পরিবার। মরে গেলেও কেউ তাঁকে দেখতে আসবেন না।

গত বৃহস্পতিবার, দু’মাস পরে ছেলেকে দেখতে গেলে মাকে ধরে কেঁদে ফেলেন যুবক। তখনই তিনি মাকে জানান মারধরের কথা। যুবকের অবস্থা দেখে পরিজনেরা তাঁকে বাইপাসের ধারের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে কড়ে আঙুলের নখ তুলে পচন ধরা জায়গায় অস্ত্রোপচার হয়েছে। আপাতত বাড়িতেই চিকিৎসাধীন যুবক।

শনিবার ওই যুবকের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, ভয়ে কুঁকড়ে রয়েছেন তিনি। কথা বলতে গেলেই থুতনি কাঁপছে। যুবকের ভাই বলেন, ‘‘১৫ বছর ধরে দাদা মানসিক সমস্যায় ভুগছে। মনোরোগ চিকিৎসক শিলাদিত্য মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমাদের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। তিনি নিজের হাসপাতালে রেখে দাদার চিকিৎসা করাচ্ছিলেন। তাতে কাজও হয়েছে। দাদাকে বাড়িতেই ওষুধ দিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন তিনি। দাদা ওষুধ খাচ্ছিল না। ফলে সমস্যা বাড়তে থাকায় প্রতিশ্রুতি ফাউন্ডেশনে দাদাকে ভর্তি করাতে বলেন শিলাদিত্য। তিনি নিজেও মাসে এক দিন করে সেখানে চিকিৎসা করাতে যেতেন।’’

আক্রান্ত যুবক বলেন, ‘‘১২ জানুয়ারি ওখানে যাওয়ার পরদিনই আমার চুল কাটিয়ে দেয়। অন্য সব আবাসিকের সঙ্গেই ওখানে একটা হল ঘরে রাখা হয়। খাটের জন্য বাবার থেকে অতিরিক্ত সাড়ে চার হাজার টাকা নিলেও মাটিতেই বিছানা পেতে পর পর সাত-আট জনকে শোয়ানো হত। ঘরের এক পাশেই শৌচাগার। কিন্তু দরজা লাগানোর ব্যবস্থা নেই। পোশাক ধুয়ে নেওয়ারও ব্যবস্থা ছিল না। একই শার্ট-প্যান্ট যে কত দিন পরেছি, ঠিক নেই!’’ যুবকের দাবি, সকলের খাওয়ার থালা মাজানো হত তাঁকে দিয়ে। ঘর মোছা, ঝাঁট দেওয়ার পাশাপাশি সেখানে পোষা কুকুরের মল-মূত্রও তাঁকে পরিষ্কার করতে হত। যুবক আরও জানান, সকলের দাড়ি কামানো হত একটাই ব্লেডে। কিছু বললেই খুব মারা হত। বাড়ির লোকের সঙ্গে দেখা করতে চাইলেও জুটত রডের ঘা। ধীরে ধীরে সারা গা চুলকোতে শুরু করে। পরিবারকে চিকিৎসকেরা জানান, হার্পিস হয়েছে যুবকের।

এ দিন প্রতিশ্রুতি ফাউন্ডেশনে গেলে দেখা যায়, তেতলা বাড়ির উপরের দু’টি তলায় মালিক ও তাঁর পরিবারের বাস। একতলায় হলঘর, রান্নার জায়গা এবং শৌচাগার নিয়ে চলে কেন্দ্রটি। যদিও ওই নেশামুক্তি কেন্দ্রের মালিক সুমন দত্তের দেখা মেলেনি। তাঁর মা ছায়া দত্ত এবং স্ত্রী পৌলোমী দত্ত মারধরের অভিযোগ স্বীকার করেছেন। তবে আবাসিকদের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রাখার যাবতীয় অভিযোগই উড়িয়ে দিয়েছেন। ছায়া বলেন, ‘‘সকলকে আমরা খুব যত্নে রাখি। ভোলা বেরা নামে এক কর্মী রাগের মাথায় ওই যুবককে মেরেছে। খুবই অন্যায় করেছে। ওকে আমরা কাজ থেকে তাড়িয়েও দিয়েছি। বিষয়টা আর না বাড়ানোই ভাল।’’

নাগেরবাজার থানার পুলিশ জানিয়েছে, নির্দিষ্ট ধারায় মামলা হয়েছে। নেশামুক্তি কেন্দ্রটির বৈধতা সংক্রান্ত সব কাগজ নিয়ে মালিকপক্ষকে দেখা করতে বলা হয়েছে। চিকিৎসক শিলাদিত্য মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এ সবের কিছুই জানা ছিল না। এক মাস বাদে গিয়ে দেখি, আমার বলা ওষুধ না দিয়ে অন্য এক চিকিৎসককে দেখিয়ে তাঁর ওষুধ খাওয়ানো হচ্ছে! সঙ্গে সঙ্গে ইস্তফা দিয়েছি। ওই পরিবারের সঙ্গে আমিও থানায় গিয়েছি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE