E-Paper

অপুর কলেজেও দাপাদাপি ভর্তি-চক্রের

ইউনিয়নের ছাত্র নেতা বা অস্থায়ী শিক্ষাকর্মী কাম প্রভাবশালী প্রাক্তনীদের মোড়কে অবতীর্ণ অবতারদের চাহিদা না মেটালে কলেজে ভর্তি হওয়ার আশা ছাড়তে হয় এ কালের অপুদের।

ঋজু বসু, আর্যভট্ট খান

শেষ আপডেট: ২৪ জুলাই ২০২৫ ০৯:২২

—প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র।

কলকাতার কলেজে পড়ে বিদ‍্যের জাহাজ হবে ভেবে মায়ের কাছ থেকে ৩০টি টাকা নিয়ে শহরে এসেছিল অপু। সেই কলেজ যে এক দিন সমান্তরাল ক্ষমতার ‘ইন্ডাস্ট্রি’ হবে, তা কেই বা ভেবেছিল। খরচ একটু বেশি বলে প্রেসিডেন্সির দিকটায় ঘেঁষেনি অপু। সিটি কলেজ আর গলির ভেতরের মেট্রোপলিটনের (আজকের বিদ্যাসাগর) থেকে রিপন কলেজের বাড়িটা পছন্দ হওয়ায় সিদ্ধান্ত নিতে দেরিও হয়নি তার। রিপন তথা আজকের সুরেন্দ্রনাথ কলেজে এ কালের মুখচোরা পাড়াগেঁয়ে তরুণদের প্রাত‍্যহিকী, সে অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলবে না ছিটেফোঁটাও।

অমুক মন্দিরের পুজোপান্ডাদের ব‍্যূহ ঠেলে নবাগতদের কলেজে ঢোকাই আকছার অসম্ভব হয়ে ওঠে আজ। কয়েক বছর আগেও মেধা তালিকায় নাম থাকলেও খাস কলকাতার কিছু কলেজে ঢুকতে না-পেরে শিক্ষার্থীদের কান্নার ছবি উঠে আসত সংবাদমাধ্যমে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তথা ‘অপুর কলেজ’ সুরেন্দ্রনাথের নাম এই তালিকার উপরের দিকেই। ছাত্র ভর্তির গোলমালে মুখ‍্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রুষ্ট বলে তিনি আসার আগে এক বার সুরেন্দ্রনাথের অধ‍্যক্ষকে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সভা মঞ্চ থেকে নামিয়ে পর্যন্ত দেওয়া হয়। তবে ছাত্র ভর্তির দুর্নীতি চক্র বা সেই চক্রের মাথাদের দাপট বন্ধ হয়নি।

ইউনিয়নের ছাত্র নেতা বা অস্থায়ী শিক্ষাকর্মী কাম প্রভাবশালী প্রাক্তনীদের মোড়কে অবতীর্ণ অবতারদের চাহিদা না মেটালে কলেজে ভর্তি হওয়ার আশা ছাড়তে হয় এ কালের অপুদের। অভিযোগ, পাশকোর্সে ১০ হাজার থেকে বিষয় অনুযায়ী অনার্সে ৩০-৪০ হাজার থেকে এক লক্ষ পর্যন্তও ইউনিয়ন নির্দিষ্ট ভর্তির দর নির্ধারিত হত বছর-বছর। গত বছর থেকে চালু অনলাইন ভর্তির কেন্দ্রীয় পোর্টাল যুগেও অবস্থা পুরোপুরি পাল্টায়নি। কারণ, পোর্টালে সিট ফাঁকা থাকলে শেষটা কলেজের উপরেই বিষয়টা ছাড়ে বিকাশ ভবন। দক্ষিণ কলকাতার একটি চেনা কলেজের অধ‍্যক্ষ বলেন, “গত বছরও শেষ পর্যন্ত তথাকথিত ইউনিয়ন নেতা বা প্রাক্তনীরা এসে বলে, স‍্যর আমাদের দেওয়া নামগুলো নিতে হবে। ভর্তি মিটতে নভেম্বর গড়িয়েছিল।”

শাসক দলের বরাভয়-পুষ্ট লেঠেল-বাহিনীর পিছনেই মুকুটহীন রাজার ভঙ্গিতে কলেজের দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা বিরাজমান। তাঁদের অনেককেই এখনও খাতির করে পরিচালন সমিতির সদস‍্য পদে বসিয়েছে রাজ‍্য সরকার। তাঁদের হুকুম ছাড়া কলেজের একটা গাছের পাতাও নড়ে না। বা তাঁদের তুষ্ট না করলে একটা দরপত্রও কলেজে পাশ হয় না। পরিচালন সমিতিতে শিক্ষক নিয়োগের ভোট থেকে স্থায়ী, অস্থায়ী কর্মী নিয়োগ, শেষ কথার হক কার্যত তাঁদের। অধ‍্যক্ষ পর্যন্ত পরিচালন সমিতির এই মাথাদের অনেককে যমের মতো ভয় পান। আর শোনা যায়, দুর্নীতিতে কলেজের ভাঁড়ার ক্রমে শূন‍্য হচ্ছে।

অপুর কলেজেই পরিচালন সমিতিতে সরকার মনোনীত সদস‍্য দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় ওরফে দেবুর মুখের ছবি দেওয়া টি-শার্টে সেজে বছর দুই আগে ছাত্রেরা সান্ধ‍্য মজলিসে শামিল হয়েছিলেন। কলেজে সাজানো হয়েছিল রঙিন গেট। কোথাও লেখা ‘হ্যাপি বার্থডে বস’ বা হ‍্যাপি বার্থডে দাদা’! সেটা মধ‍্য ষাটের দেবাশিসের জন্মোৎসব। একাদশ শ্রেণি থেকে ডিগ্রি কোর্স, তার পরে বিএ এলএলবি— সুরেন্দ্রনাথেই দীর্ঘ ছাত্রদশা কেটেছে তাঁর। নিজেই বলেন, কলেজে ইউনিয়নের জিএস, প্রেসিডেন্ট হওয়ার কথা। সিপিএমের সঙ্গে লড়াই করে বাঁ কানের খানিকটা কাটা যাওয়ার বীরগাথাও শোনান দেবু। একদা কান হারানোর সেই ইতিহাসের সূত্রেই পরিচিত ছিলেন। এখন তৃণমূল জমানায় তিনিই সুরেন্দ্রনাথে সর্বজনমান‍্য ‘দাদা’ বা ‘বস’ হয়েছেন।

আইনজীবী হিসেবে লড়তে দেবুকে তেমন দেখা যায়নি। তবে আদালত মহলে তাঁর প্রভাব বরাবরই সবার জানা। কংগ্রেসের সোমেন-শিবিরের অনুগামীটি নেতার সঙ্গেই মমতা-শিবিরে নাম লিখিয়েছিলেন। পরে সোমেন কংগ্রেসে ফিরলেও দেবু আর গুরুর ছত্রচ্ছায়ায় ফেরেননি। রাজ্যে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কয়েক বছরের মধ‍্যেই একটি ঘটনা সুরেন্দ্রনাথে এখনও ভয়ে-ভয়ে গুঞ্জরিত হয়। ইংরেজি বিভাগের একটি সেমিনারে উইলিয়ম শেক্সপিয়রের ছবি দেখে দেবু-বাহিনীর বিদ্রোহী সত্তা জাগ্রত হয়। শোনা যায়, সেমিনার কার্যত ভন্ডুল করে বিভাগীয় প্রধানকে বাক‍্যবাণে বেঁধা হয়েছিল। লোকে বলে, সেটা সামান‍্য ‘মিসফায়ার’! শেক্সপিয়রকে একটু গুলিয়ে দেবুরা মার্ক্স বা লেনিন ভেবে বসেন।

কসবার সাউথ ক‍্যালকাটা ল কলেজে গণধর্ষণে অভিযুক্ত মনোজিৎ মিশ্র বা তার শাগরেদ জাইব আহমেদদের আইনের প্রবেশিকার-র‌্যাঙ্ক নিয়ে অনেকে হতবাক! মনোজিৎ কোর্স থেকে ছিটকে গিয়েও কোন জাদুবলে আবার ওই কলেজে ঢোকে। জাইব ২৬৩৪ র‌্যাঙ্ক পেয়েছিল। সরকারি কলেজে সাধারণত ৫০০-র নীচের র‌্যাঙ্কে কারও ঢোকা কার্যত অসম্ভব। অভিযোগ, কসবার কলেজ আর সুরেন্দ্রনাথে পরীক্ষার স্বাভাবিক র‌্যাঙ্ক টপকে এমন সসম্মানে প্রবেশের নমুনা ভূরি ভূরি। কলকাতার মেজ, সেজ কলেজে ভর্তি বাবদ এই সে দিনও হেসেখেলে টেবিলের তলায় ৫০ লক্ষ টাকা আদায়ের কাহিনি বহুচর্চিত। এর পাশে ল কলেজে ভর্তির আমদানি কয়েক গুণ উপরে থাকবে বলে শোনা যায়। কলকাতার একটি আইন কলেজ প্রশাসনের ঘনিষ্ঠ সূত্রই বলেন, কসবার আইন কলেজে ৮-১০টা আসনে ভর্তি দুর্নীতি ঘটলে সুরেন্দ্রনাথে সংখ‍্যাটা কয়েক গুণ বেশি। কলেজের প্রভাবশালীদের লম্বা হাত অনেক দূর বিস্তৃত। কাউন্সেলিং পর্বে কখন, কার উপস্থিতি, সব তাঁরা খেয়াল রাখেন। শূন‍্যস্থান পূরণে তৎপরও হন। কয়েক লক্ষ টাকাতে এর পরেই নিচু তলার র‌্যাঙ্কধারীদের সঙ্গে রফা হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রটির ব‍্যাখ‍্যা, বেসরকারি কলেজে আইন পড়তে পাঁচ বছরে ৮-১০ লক্ষও লাগে। ৩-৪ লক্ষ দিয়ে সরকারি কলেজে ঢুকলেও তাই সাশ্রয় হয়। আর আইন কলেজে ভর্তি ব‍্যবস্থাটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে ভর্তি বাবদ কোটি টাকা আদায়ও তাই অসম্ভব নয়। এবং এই টাকার বখরা রাজনৈতিক মহল বা কলেজ তথা শিক্ষা প্রশাসনের নানা স্তরেও পৌঁছয় বলে অভিযোগ।

বছর দুই আগেই সুরেন্দ্রনাথ ও কসবার ল কলেজে প্রথম সিমেস্টারের পরীক্ষার সময়ে বেশ কয়েক জন শিক্ষার্থীর ভর্তি নিয়েই জট সামনে এসেছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁদের অ‍্যাডমিট কার্ড দেননি। শোনা যায়, কলেজ থেকে ছিটকে ওই পড়ুয়াদের কেউ কেউ বেসরকারি আইন কলেজেও ঢোকেন। সুরেন্দ্রনাথ ল কলেজের উপাধ‍্যক্ষ মহম্মদি তারান্নুম বলেন, “কিছু ছাত্রের কাগজপত্রে গোলমাল ছিল। বিষয়টা মিটে গিয়েছে।” সুরেন্দ্রনাথের দিবা কলেজ, নৈশ কলেজ, আইন কলেজ এবং প্রভাতী মেয়েদের কলেজে পরিচালন সমিতিতে সরকারি প্রতিনিধি হয়ে বসে আছেন দেবু। তাঁর পুত্র শিবাশিস আইন কলেজে সরকার পোষিত শিক্ষক (স‍্যাক্ট)। তিনিও পরিচালন সমিতিতে আছেন। এমন পারিবারিক পরম্পরা আরও অনেক কলেজেই। দেবুর বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ পুলিশেরও কানে এসেছে। নানা গোলমালের অভিযোগে দেবুকে কখনও গা-ঢাকাও দিতে হয়েছে। কলেজে টেন্ডারে অনিয়ম বা ভর্তি দুর্নীতির চক্র নিয়ে অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে দেবাশিস বলেন, “এ সব মিথ‍্যা। হিংসুটেরা বলে। কলেজের শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী থেকে ছাত্রছাত্রী— কাউকে জিজ্ঞেস করুন তো! একটা কথা কেউ আমার বিরুদ্ধে বলবে?” কলেজে কলেজে এখন এমন সব চরিত্রেরই দাপাদাপি।

(চলবে)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

College admission Union Colleges West Bengal government

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy