E-Paper

‘মেজদা’দের দাপটে তটস্থ অধ্যক্ষও

বঙ্গবাসী কলেজের জহর নিজেকে বাম জমানায় বিরোধীদের লড়াইয়ের পুরনো সৈনিক বলেন। কেউ কেউ বলেন, ওই কলেজগুলির অধ‍্যক্ষের ঘরে না কী মূর্তিমান সিসি ক‍্যামেরার মতো অবস্থান করতেন জহর।

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ২৭ জুলাই ২০২৫ ০৬:০১

—প্রতীকী চিত্র।

সত্তরোর্ধ্ব ‘জহরবাবুর’ জীবনে অবসর বলে কিছু নেই। শিয়ালদহ এলাকার কলেজের সঙ্গে কার্যত সমার্থক তিনিই। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবাসী কমার্স কলেজ থেকে পাশ করার পরেও সম্পর্ক ছিন্ন হয়নি। ১৯৮৩ থেকে শিক্ষাকর্মী হিসেবে কাজ করেছেন বঙ্গবাসী সান্ধ‍্য কলেজে। অবসরের এক দশক বাদেও সম্পর্ক রীতিমতো আঁটোসাঁটো।

লোকে বলে, বঙ্গবাসী প্রভাতী, দিবা, সান্ধ‍্য এবং কমার্সে (আচার্য গিরিশচন্দ্র বসু কলেজ) জহরলাল দাসই এখনও সর্বেসর্বা। সম্প্রতি সান্ধ্য কলেজের পরিচালন সমিতির (জিবি) সদস‍্য পদ ছেড়েছেন। বাকি তিনটির জিবিতে সরকার মনোনীত সদস‍্য পদে বহাল স্বমহিমায়। স্বভাব বিনয়ী জহর বলেন, “এমএলএ সাহেব (নয়না বন্দ্যোপাধ্যায়) রেখেছেন! আছি।”

মধ‍্য কলকাতার আর একটি কলেজে প্রভাবশালী জিবি সদস‍্যের আশীর্বাদে আবার রমরমা, আপাত ভাবে অস্থায়ী কর্মী জনৈক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষাকর্মীর। একদা কলেজের হেডক্লার্ক বা বড়বাবু ছিলেন তিনি। এখনও সকলেই তাঁকে সমঝে চলেন। অস্থায়ী কর্মী হিসেবে নিজে বেতন নেন। তাঁর পুত্রও কলেজের অস্থায়ী কর্মী। শোনা যায়, কলেজের ভিতরে পছন্দের ডিউটি পেতে কর্তৃপক্ষের ঘনিষ্ঠ ক্ষমতার এই বলয়টিকে খুশি রাখতে হয়। পছন্দের কর্মীদের জন‍্য এই ‘মেজদার’ ছাড়ও থাকে। আবার প্রভাবশালী শিক্ষাকর্মীটির বিরাগভাজন হলে পুজোর ছুটিতেও কলেজে রাতভর ডিউটি করতে হয়।

বঙ্গবাসী কলেজের জহর নিজেকে বাম জমানায় বিরোধীদের লড়াইয়ের পুরনো সৈনিক বলেন। কেউ কেউ বলেন, ওই কলেজগুলির অধ‍্যক্ষের ঘরে না কী মূর্তিমান সিসি ক‍্যামেরার মতো অবস্থান করতেন জহর। তাঁকে এড়িয়ে শিক্ষকদের জন‍্য কোনও আলোচনাই ছিল দুঃসাধ্য। শোনা যায়, কলেজের যে কোনও সিদ্ধান্তেই তাঁর প্রভাবের ছায়া প্রলম্বিত। জহর বলেন, “লোকে বলে আমার ভাই নাকি কলেজের কর্মী! ভুল তথ‍্য!” তবে জহরের সঙ্গে বঙ্গবাসীর সম্পর্কটা গভীর ভাবে পারিবারিকই। তাঁর কন‍্যা সেখানে সরকার পোষিত শিক্ষিকা। পুত্র কলেজের জিমের ইনস্ট্রাক্টর।

এ অবশ‍্য কোনও বিচ্ছিন্ন কলেজের গল্প নয়। কোনও কোনও কলেজে শিক্ষাকর্মীদের দাপটে অধ্যক্ষও তটস্থ থাকেন। ছাত্রনেতা থেকে শিক্ষাকর্মী হিসেবে যুক্ত কলেজের সুহৃদবর্গের অনেকেরই শিকড় কলেজের মাটিতে আষ্টেপৃষ্ঠে ছড়িয়ে। কেউ কেউ বনস্পতি হয়ে ওঠেন। কসবা-কাণ্ডের মনোজিৎ মিশ্রের ঘনিষ্ঠ দাদা বলে পরিচিত তৃণমূলের ছাত্র যুব নেতা সার্থক বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন আশুতোষের প্রাক্তনী। আশুতোষেই পরীক্ষা দিয়ে তিনি আশুতোষ কলেজের বড়বাবু হয়েছেন। কলকাতার তিন-চারটি গুরুত্বপূর্ণ কলেজে জিবি-র সরকার মনোনীত সদস‍্যও তিনি।

জীবনের লম্বা সময় জয়পুরিয়া কলেজে কাটানো রাহুল ঝা-এর সঙ্গে কলেজের যোগও কাঁঠালের আঠার মতো। বাম জমানায় এসএফআই, পরে টিএমসিপি রাহুল পরীক্ষা দিয়ে জয়পুরিয়ার স্থায়ী কর্মী। কলেজের পুরনো ছাত্রনেতা রোহিত সোনকরও জয়পুরিয়ার স্থায়ী শিক্ষাকর্মী। সুরেন্দ্রনাথেও পুরনো ছাত্রনেতা বা প্রাক্তন জিএসের চাকরি করার নমুনা রয়েছে। বঙ্গবাসীতে একদা স্নাতক না হওয়া বিকম-এর ছাত্রনেতা সঞ্জয় পাণ্ডেও চাকরি পেয়ে এখন প্রভাতী কলেজের জিবি-র শিক্ষাকর্মী প্রতিনিধি।

সঞ্জয়ের চাকরি প্রসঙ্গে জহর বলেন, “পুরনো ছাত্রনেতা চাকরি পেলে ক্ষতি কী! আর জিবিতে এখন সঞ্জয় আছেন। পরে হয়তো অন‍্য কেউ থাকবেন!” সুরেন্দ্রনাথের প্রাক্তনীদের কলেজে পুনর্বাসন প্রসঙ্গেও জিবি-র প্রভাবশালী সরকারি প্রতিনিধি দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত, “বেকার ছেলের চাকরি হলে সমস‍্যা কিসের!” বাস্তবে দেখা যায়, কলেজের স্থায়ী শিক্ষাকর্মীর শূন‍্য পদ পূরণের সুযোগ এলে বার বার কলেজের পুরনো ছাত্রনেতারাই ঠাঁই পান। মনোজিতের মতো অস্থায়ীদের ক্ষেত্রে তো কথাই নেই।

এঁরাই অনেকে আবার কলেজে কলেজে তৃণমূল শিক্ষাবন্ধু সমিতির পতাকাও টানছেন। শিক্ষাঙ্গনে শাসক দলের সংগঠনের নানা কর্মসূচির তাঁরা দোসর। বর্ধমানের একটি কলেজে অ‍্যাকাউন্ট‍্যান্টও নেই। কলেজের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র বলছে, অধ্যক্ষ ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকেন। পরে জিবি-র সঙ্গে মতানৈক্য ঘটলে, অতি সহজেই প্রভাবশালী অস্থায়ী শিক্ষাকর্মী এবং ছাত্রনেতারা মিলে তাঁর নামেই টাকা নয়ছয়ের মিথ‍্যা অপবাদ দিতে পারেন। অনেক জেলার কলেজেই আবার কলেজের দফতরে জমা পড়া ভর্তির টাকা কিছু দিন অন‍্য কোথাও সরিয়ে রেখে তার থেকে সুদ উপার্জনের অপচেষ্টার অভিযোগ উঠে আসে। পরে হয়তো টাকাটা কিছুটা কাটছাঁট করে আবার কলেজের তহবিলে জমা দেওয়া হল।

কলেজের প্রাক্তন ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক তথা পোড়খাওয়া এক অধ‍্যাপকের অভিজ্ঞতা, কলেজে দুর্নীতির আসল চাবিকাঠিই হল অস্থায়ী শিক্ষাকর্মীদের মাধ‍্যমে কলেজের অফিসঘর দখল। অনলাইন পোর্টালের যুগে ভর্তি নিশ্চিত হওয়ার পরেও অফিসের ওই শিক্ষাকর্মীরা কোনও পড়ুয়াকে নেতৃত্বহীন ইউনিয়নের দাদাদের হাতে তুলে দিতে পারেন। ঝানু পুজোপান্ডার হাতে পড়ার মতো তখন খানিকটা প্রণামী না দিলে আনকোরা ছাত্রের মুক্তি পাওয়া কঠিন হয় বলেই অভিযোগ।

এক প্রবীণ অধ‍্যক্ষের কথায়, “ভর্তির সময়ে কলেজে প্রাক্তনী বা শিক্ষাকর্মী পরিচয়ে কারা ঢুকছে তা নিয়ন্ত্রণ করা গেলে উপকার হত। এমনিতে কাজের সময় তাঁদের দেখা মেলে না। কিন্তু ভর্তির সময়ে মাটি ফুঁড়ে উদয় হন।” অনেক শিক্ষক, অধ‍্যক্ষের মত, আগেও কলেজ প্রশাসনে কারও কারও ইন্ধনে অনিয়ম-বেনিয়ম ঘটত। কিন্তু অযোগ্য শিক্ষাকর্মীদের সংখ্যা বাড়ায় এখন কাজে অসুবিধে বেশি হচ্ছে। তাঁরা বলছেন, “ভর্তির সময়ে কলেজের ভাবমূর্তি রক্ষায় বাড়তি শৃঙ্খলা থাকলেই ভাল হত। যে হারে স্নাতকে ভর্তির উৎসাহ কমছে, আর্টসের কিছু বিষয় থেকে পদার্থবিদ‍্যা, রসায়নের ক্লাসে মাছি তাড়াতে হচ্ছে, তাতে ভর্তি নিয়ে অনভিপ্রেত কিছু ঘটলে তা ভবিষ্যতে আরও করুণ পরিস্থিতি তৈরি করবে।” রাজনীতির কারবারিরা কলেজগুলিকে ক্রমশ কাঁচা টাকা রোজগারের সোনার ডিম পাড়া হাঁস হিসেবে দেখেছেন। এখন শিক্ষার্থীরা কলেজ বিমুখ হওয়ার দিনে সেই স্বর্ণডিম্ব-প্রসবিনীর আয়ুর মেয়াদ নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।

(শেষ)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Threat Culture in Education WB Colleges Unions

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy