Advertisement
০৫ মে ২০২৪
আঁধারের পাশে আলোও

‘মেয়েটাকে দেখেই আমার মরা বোনের মুখখানা চোখে ভাসছিল!’

রক্ষক ও ভক্ষক। মাত্র দু’দিনের ব্যবধান। ট্যাক্সিচালকদের দুই ভিন্ন পরিচয়ের সাক্ষী হল কলকাতা। মঙ্গলবার রাতে ব্রেবোর্ন রোডের ফুটপাথ থেকে এক বালিকাকে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণের পরে খুন করে দুই লাক্সারি ক্যাবের চালক।

আহমেদ আলি। —নিজস্ব চিত্র।

আহমেদ আলি। —নিজস্ব চিত্র।

শিবাজী দে সরকার
শেষ আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০১:৪৭
Share: Save:

রক্ষক ও ভক্ষক।

মাত্র দু’দিনের ব্যবধান। ট্যাক্সিচালকদের দুই ভিন্ন পরিচয়ের সাক্ষী হল কলকাতা। মঙ্গলবার রাতে ব্রেবোর্ন রোডের ফুটপাথ থেকে এক বালিকাকে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণের পরে খুন করে দুই লাক্সারি ক্যাবের চালক। এ খবর আগেই তোলপাড় ফেলেছে। এ বার জানা গেল, তার আগেই রবিবার রাতে শিয়ালদহ স্টেশন চত্বরে উত্ত্যক্তকারীদের হাত থেকে ঘরছাড়া এক কিশোরীকে উদ্ধার করেন এক হলুদ ট্যাক্সির চালক। আহমেদ আলি নামে সেই ট্যাক্সিচালক ‘ভাইয়ার’ হাত ধরেই এ শহরে নতুন করে পরিবার পেয়েছে সেই কিশোরী।

পুলিশ সূত্রের খবর, ওই রাতে সেই কিশোরীকে শিয়ালদহ স্টেশনে প্রথম বার দেখেন আহমেদ। অভিযোগ, ওই মেয়েটিকে তখন উত্ত্যক্ত করছিল ওই তল্লাটে ‘পাতাখোর’ বলে পরিচিত মাদকাসক্ত কিছু ছিঁচকে দুষ্কৃতী। আহমেদের কথায়, ‘‘ও (মেয়েটি) ভয়ে কাঁপছিল।’’ স্থানীয় সূত্রের খবর, আহমেদ ও ক’জন ট্যাক্সিচালক বিষয়টি দেখতে পেয়ে রুখে দাঁড়ান। মাদকাসক্তেরা পিছু হটে। কিন্তু কয়েক জন হকার ও কুলির সাহায্যে মেয়েটিকে শিয়ালদহের জি আর পি থানায় নিয়ে গিয়ে তাঁরা ফ্যাসাদে পড়েন। প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে পুলিশ জানতে পেরেছে, রেল পুলিশ ওই রাতে কিছুতেই বিপন্ন মেয়েটির দায়িত্ব নিতে রাজি হয়নি। শেষমেশ স্টেশনের প্ল্যাটফর্মেই কিশোরীকে নিয়ে ফিরে যেতে হয় উদ্ধারকারীদের। রেল পুলিশ যদিও তাদের বিরুদ্ধে ওঠা এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

অত রাতে মেয়েটিকে একা স্টেশনে ফেলে আসতে কিছুতেই মন চায়নি আহমেদের। বছর পঁচিশের ওই ট্যাক্সিচালকের কথায়, ‘‘বারবার মনে হচ্ছিল, ওর কিছু হলে নিজেকে ক্ষমা করব কী ভাবে!’’ এন্টালির মতিঝিল বস্তির বাড়িতে ফিরে সে কথা বলতেই এ বার আসরে নামেন মা আলমারা বিবি। ছেলেকে বকুনি দিয়ে বলেন, তিনি নিজে যাবেন মেয়েটিকে আনতে। এন্টালির বস্তিতে আহমেদের ওই ঘুপচি ঘরে থাকেন ওই ট্রাক্সিচালকের স্ত্রী, আড়াই বছরের ছেলে এবং ছোট ভাই। মা-ছেলে সঙ্গে সঙ্গে স্টেশনে গিয়ে রাতটুকুর জন্য তাকে ঘরে নিয়ে আসেন। মাঝে আলমারা বিবি জ্বরে পড়ে যাওয়ায় দু’দিন দেরি হয়। বুধবার সকালে এন্টালি থানার পুলিশকে সব জানিয়ে গোটা পরিবার মেয়েটিকে দিয়ে আসে। তখনই পুলিশ মেয়েটির পরিচয় জানতে পারে।

পুলিশ জানিয়েছে, মেয়েটির বাড়ি নদিয়ার শান্তিপুর এলাকায়। বহুদিন আগেই মৃত্যু হয়েছে তার বাবার। মা আবার বিয়ে করে অন্যত্র থাকেন। কখনও মামা, কখনও কাকাদের ঘরে দিন কাটত মেয়েটির। কয়েক দিন আগে পরিচিত এক যুবক মেয়েটিকে ফুঁসলিয়ে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ। ওই যুবকটি তাকে ভিন্‌ রাজ্যে নিয়ে গিয়েছিল। পরে কলকাতায় ফিরে মেয়েটিকে শিয়ালদহ স্টেশনে অপেক্ষা করতে বলে সে উধাও হয়ে যায় বলে দাবি পুলিশের। ওই কিশোরীর অভিযোগের ভিত্তিতে সেই যুবকের নামে অপহরণের মামলা দায়ের করেছে এন্টালি থানার পুলিশ। পুলিশ জানায়, অভিযুক্ত ওই যুবকের মোবাইল বন্ধ। তাকে খোঁজার চেষ্টা চলছে। নদিয়ায় মেয়েটির বাড়ির লোকের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয় পুলিশের তরফে। পরে পুলিশ জানায়, মেয়েটির দায়িত্ব নিতে নিমরাজি তার আত্মীয়রা। তবু শিয়ালদহ স্টেশনে উদ্ধার অনাত্মীয় মেয়েকে নিজেদের ঘরে রাখতে পারেননি তার কলকাতার ‘মা’ ও ‘ভাইয়া’। দেশের আইন মেনে ওই কিশোরীকে সরকারি হোমে তুলে দিয়েছে স্থানীয় এন্টালি থানার পুলিশ। সমাজকল্যাণ দফতরের শিশু কল্যাণ সমিতির মাধ্যমে সরকারি হোমেই তাকে রাখা হয়েছে।

তপসিয়ার খালে ধর্ষণ ও খুন করে বালিকাকে ভাসিয়ে দেওয়ার ঘটনাটির কথাও এ দিন বলছিলেন আলমারা বিবি। তাঁর কথায়, ‘‘যা দিনকাল, মেয়েটিকে স্টেশনে ছেড়ে রাখা কখনও ঠিক হতো না।’’ ওই মহিলার নিজের মেয়ে বছর দুয়েক আগে মারা গিয়েছে। তার বয়সও স্টেশনের ওই কিশোরীর মতোই। আহমেদও বলছিলেন, ‘‘মেয়েটাকে দেখেই আমার মরা বোনের মুখখানা চোখে ভাসছিল! তবু মাকে বলার আগে ওকে বাড়িতে নিয়ে আসার সাহস পাইনি। যদি কিছু ঝামেলা হয়!’’ এখন হোমে ছাড়তে হলেও সুযোগ পেলেই ফের ওই কিশোরীর সঙ্গে দেখা করতে মুখিয়ে থাকবে গোটা পরিবার। ‘ভাইয়া’ আহমেদ আলি পেশায় ট্যাক্সিচালক। ঘরে স্ত্রী ও মা রয়েছেন। বৃহস্পতিবার বিকেলে এন্টালির ঘুপচি ঘরে বসে ‘ঘরের মেয়ে’র বিষয়ে এ সব কথা বলতে বলতে তাঁদের সকলেরই যেন চোখ চিকচিক করে উঠছিল।

দু’দিনের জন্য পারিবারিক জীবনের স্বাদটুকু পেয়ে মেয়েটিও জড়িয়ে পড়েছিল বলেই জানাচ্ছে পুলিশ। থানার ‘কাকু’দের সে বলে, ‘‘আমায় অন্য কোথাও পাঠিও না। ওরা ভাল মানুষ। আমি ওদের কাছেই থাকব।’’ থানায় দাঁড়িয়ে আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সকলেও তখন চোখের জলে ভাসছেন।


(তথ্য সহায়তা: সুস্মিত হালদার)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Rape Ola driver Minor
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE