Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

যাকে ধরেছিলেন, ধর্মতলার সেই ‘গুন্ডা’র পুজোতেই লালবাজারের গুন্ডাদমন কর্তারা

মাস কয়েক আগে জুয়ার ঠেক চালানোর অভিযোগে পার্ক স্ট্রিটের একটি পাঁচ তারা হোটেল থেকে গ্রেফতার করা হয়েছিল বিশাল খটিক নামে ওই ব্যক্তিকে।

বিশাল খটিক উত্তরীয় পরিয়ে বরণ করে নিচ্ছেন শুভব্রত কর (বাঁ দিক থেকে প্রথম), প্রসূন দে সরকার, সুজিত চক্রবর্তীকে (দূরে বসে)। নিজস্ব চিত্র

বিশাল খটিক উত্তরীয় পরিয়ে বরণ করে নিচ্ছেন শুভব্রত কর (বাঁ দিক থেকে প্রথম), প্রসূন দে সরকার, সুজিত চক্রবর্তীকে (দূরে বসে)। নিজস্ব চিত্র

সিজার মণ্ডল
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০১৯ ১৮:৩৭
Share: Save:

জুয়ার ঠেক চালানোর অভিযোগে মাস কয়েক আগে তাকে গ্রেফতার করেছিল কলকাতা পুলিশের গুন্ডাদমন শাখা। সেই মামলার বিচার প্রক্রিয়া এখনও চলছে। এরই মধ্যে ওই ব্যক্তির কালীপুজোয় অতিথি হিসেবে দেখা গেল গুন্ডাদমন শাখারই তিন দুঁদে গোয়েন্দাকে। তাঁদের উত্তরীয় পরিয়ে বরণও করলেন ওই ব্যক্তি! এক জন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার এবং দু’জন সাব ইনস্পেকটর পদমর্যাদার কর্মীর এমন ‘জন সংযোগ’-এর ঘটনায় রীতিমতো অস্বস্তিতে খোদ লালবাজার। যদিও ওই তিন জনের বিরুদ্ধে এখনও পর্যন্ত বিভাগীয় কোনও তদন্তের নির্দেশ দেয়নি কলকাতা পুলিশ।

বাম আমলের শেষ মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যই হোন বা রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়— পুলিশকে বারেবারেই সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেশার পরামর্শ দিয়েছেন। দিয়েছেন জনসংযোগ বাড়ানোর নিদানও। রাজ্যের অনেক জায়গাতেই সেই পরামর্শ মানতে দেখা গিয়েছে পুলিশকে। ফুটবল থেকে পিকনিক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হোক বা ধর্মীয় উৎসব— পুলিশকে বারংবার দেখা গিয়েছে সাধারণ মানুষের উদ্যোগের সঙ্গে মিশে যেতে। কিন্তু যাঁকে অপরাধী হিসাবে গ্রেফতার করা হল, কয়েক মাসের মধ্যে তাঁর পুজোয় অতিথি হয়ে চলে যাওয়া, এমন ‘জন সংযোগ’-এর কথা মনে করতে পারছেন না কোনও প্রাক্তন পুলিশকর্মী।

মাস কয়েক আগে জুয়ার ঠেক চালানোর অভিযোগে পার্ক স্ট্রিটের একটি পাঁচ তারা হোটেল থেকে গ্রেফতার করা হয়েছিল বিশাল খটিক নামে ওই ব্যক্তিকে। কে এই বিশাল? নিউমার্কেটের বাইরে লিন্ডসে স্ট্রিট পার্কোম্যাটের পাশে প্রতি বছরই বেশ ধূমধাম করে কালীপুজো হয়। খাতায় কলমে পুজোর উদ্যোক্তা সেন্ট্রাল কলকাতা অ্যান্ড লিন্ডসে ইয়ুথ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন। নিউমার্কেট এলাকায় সকলেই জানেন, ওই পুজোটি আসলে স্থানীয় খটিক পরিবারের। ওই পুজোরই সম্পাদক বিশাল খটিক। তিনি ওই ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদকও। জুয়ার ঠেক চালানোর অভিযোগে গ্রেফতার করা মামলায় বিশালের বিরুদ্ধে চার্জশিটও দিয়েছে পুলিশ। এখনও বিচারপ্রক্রিয়া চলছে। বিশাল যদিও নিজের পরিচয় দেন কলকাতা পুরসভার ৬৩ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল যুব কংগ্রেসের সভাপতি হিসাবে।

আরও পড়ুন:জোর করে বিজোড় নম্বরের গাড়ি নামিয়ে জরিমানা দিলেন বিজেপি সাংসদ, পেলেন ফুলের তোড়া
আরও পড়ুন:ছট শেষে সরোবরের জলে ভেসে উঠছে মরা কচ্ছপ-মাছ! ভোটের জন্য সবাই চুপ, বলছেন পরিবেশবিদরা​

কালীপুজোর আগের দিন ওই পুজোর উদ্বোধন করেন তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্য সভাপতি এবং সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক সুব্রত বক্সী। উদ্ধোধনের দিন এসেছিলেন বলিউড তারকা ববি দেওল। ওই সন্ধ্যাতেই বিশালের কালীমণ্ডপে বিশেষ অতিথি হিসাবে দেখা যায় কলকাতা পুলিশের গুন্ডাদমন শাখার দায়িত্বে থাকা অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার (এসি) সুজিত চক্রবর্তী ও দুই সাব ইনস্পেক্টর প্রসূন দে সরকার এবং শুভব্রত করকে। বিশাল ওই তিন গোয়েন্দা অফিসারকে উত্তরীয় পরিয়ে বরণ করে নিচ্ছেন, এমন দৃশ্যও দেখা যায় ওই দিন।

সদর স্ট্রিট, মির্জা গালিব স্ট্রিট থেকে শুরু করে নিউমার্কেট এলাকার সকলেই একডাকে চেনেন বিশালকে। নিউমার্কেট থানায় একটা সময়ে কর্মরত এক পুলিশ আধিকারিক বলেন, ‘‘ওই এলাকায় বিভিন্ন ধরনের বেআইনি ব্যবসার পিছনে রয়েছে খটিক পরিবার। বিশালের জেঠতুতো দাদা কালী খটিককে পুজোর আগেই পুলিশ গ্রেফতার করেছিল। কারণ, তিনি পুলিশ কর্মীকে মারধর করেছিলেন। বিশাল এবং খটিক পরিবারের অনেকের বিরুদ্ধেই নিউমার্কেট থানায় একাধিক অভিযোগ রয়েছে।’’ সেগুলো কী ধরনের অভিযোগ? ওই আধিকারিকের কথায়, ‘‘মূলত মারামারি, তোলাবাজি, বেআইনি মদের কারবার চালানো... এই সব আর কী!’’ লিন্ডসে স্ট্রিট চত্বরে ব্যাগ ফেরি করা এক হকার যেমন বলছিলেন,‘‘গোটা চত্বরের হকাররা কে কোথায় বসবেন, সবটাই ঠিক করেন বিশাল।”

এ হেন বিশাল-পুজোতে অতিথি হয়ে গোয়েন্দাদের যাওয়ার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসতেই অস্বস্তিতে কলকাতা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। এসি পদমর্যাদার এক আধিকারিক যেমন বলছেন, ‘‘বিশাল খটিকের মামলা যাঁদের হাতে, তাঁরাই ওর পুজোতে অতিথি! বিষয়টা বেশ দৃষ্টিকটূ। এতে অপরাধীদের কাছে অন্য রকম বার্তা যায়।” কিন্তু এই যাওয়ায় কোনও অন্যায় দেখছেন না গুন্ডাদমন শাখার আধিকারিকরা। ওই পুজোয় যাওয়া তিন আধিকারিকের এক জন বলছেন, ‘‘বিশালের দাদা কালীর বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ রয়েছে। তবে বিশালের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ রয়েছে বলে আমি জানি না।’’ আর ওই এসি-র ঘনিষ্ঠ এক আধিকারিক বলছেন, ‘‘পুজো তো সবাইকে নিয়ে। আর বিশাল গ্রেফতার হয়েছিল আগেই। এখন তো কোনও অপরাধ করেনি।” কলকাতা পুলিশের এক শীর্ষ আধিকারিক বলছেন, ‘‘বিষয়টি খবর নিয়ে দেখছি।’’

আর বিশাল কী বলছেন এ প্রসঙ্গে?

সদর স্ট্রিটে নিজের অফিসে বসে এ দিন তিনি বলেন, ‘‘ওই পুজোর শুরু আমার বাবা বিজয় খটিকের হাতে। পুজো তো সকলের। তাই নেমন্তন্ন করেছিলাম লালবাজারের গোয়েন্দাদের। সুজিতদা তো এসেওছিলেন। এতে অন্যায়ের কী আছে!’’ যাঁরা আপনাকে গ্রেফতার করলেন, তাঁদেরই পুজোয় ডাকলেন? এ প্রশ্নের জবাবে বিশালের হাসিমাখা জবাব, ‘‘ওটা তো একটা ভুল বোঝাবুঝি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Lalbazar New Market Kolkata Police Bishal Khatik
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE