ফাইল চিত্র।
বেআইনি হকারদের ক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে কলকাতার বিদায়ী পুর প্রশাসক ফিরহাদ হাকিমের মন্তব্যকে কেন্দ্র করে বিতর্ক শুরু হল।
হকার-নীতি প্রণয়নের জটিলতার নেপথ্যে রাজনীতি না অন্য কারণ, এ প্রশ্নের উত্তরে ফিরহাদ আনন্দবাজার পত্রিকাকে বলেছিলেন, ‘‘হকার কোনও রাজনৈতিক দল বসায় না। হকার বসায় এক শ্রেণির পুলিশ, রোজগারের জন্য।’’ যার
পরিপ্রেক্ষিতে পুর প্রশাসনেরই একাংশ মনে করছে, বেআইনি হকারদের দখলে চলে যাওয়া ফুটপাত নিয়ে তিতিবিরক্ত নাগরিক সমাজের ‘মন পেতে’ আসন্ন পুরভোটের প্রেক্ষাপটে সচেতন ভাবেই পুলিশকে দায়ী করেছেন ফিরহাদ।
তবে পুরকর্তাদের একাংশ হকার নিয়ন্ত্রণে পুরসভার ভূমিকার কথা মনে করাতে কলকাতা পুর আইন, ১৯৮০-র ৩৭১ নম্বর ধারার উল্লেখ করছেন। সেখানে রাস্তা এবং ফুটপাতে বাধা সৃষ্টিকারী স্থায়ী বা অস্থায়ী যে কোনও কাঠামোয় নিষেধাজ্ঞা জারির পূর্ণ ক্ষমতা পুর কমিশনারকে দেওয়া হয়েছে। নিয়ম লঙ্ঘন করে কেউ রাস্তা বা ফুটপাতে কিছু রাখলে, নির্মাণ করলে বা বিক্রি করলে তা সরানোরও পূর্ণ ক্ষমতা কমিশনারের। হকার-নীতি সংক্রান্ত যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ন্যস্ত রয়েছে ‘টাউন ভেন্ডিং কমিটি’র উপরে। স্থানীয় পুর প্রশাসন, পুলিশ, ট্র্যাফিক পুলিশ, আবাসিক ও বাজার সংগঠন, স্বাস্থ্য আধিকারিক, নগর পরিকল্পক, হকার-সহ বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত এই কমিটির চেয়ারপার্সন কিন্তু পুর কমিশনারই (কলকাতার মতো কর্পোরেশন এলাকার ক্ষেত্রে)। এবং পুরসভার ক্ষেত্রে চিফ এগ্জিকিউটিভ অফিসার বা এগ্জিকিউটিভ অফিসার।
১৯৯৬ সালের হকার-উচ্ছেদ অভিযান ‘অপারেশন সানশাইন’-এর পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের প্রসঙ্গও উঠে এসেছে এই বিতর্কে। ১৯৯৭ সালে হকার সংক্রান্ত নীতির সংশোধনীতে হকারিকে জামিন-অযোগ্য শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছিল। হকারদের অন্যতম সংগঠন ‘হকার সংগ্রাম কমিটি’র সভাপতি শক্তিমান ঘোষের কথায়, ‘‘ওই অমানবিক আইনের তুমুল বিরোধিতা করেছিলাম। যে কারণে আইন হলেও শেষ পর্যন্ত তা কার্যকর হতে পারেনি।’’
হকার নিয়ন্ত্রণে পুর ভূমিকার ক্ষেত্রে ‘ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব স্ট্রিট ভেন্ডর্স অব ইন্ডিয়া’র (এনএএসভিআই) সমীক্ষাও উল্লেখযোগ্য বলে মত অনেকের। দেশের সাতটি শহরকেন্দ্রিক (মুম্বই, আমদাবাদ, কলকাতা, ইম্ফল, পটনা, ভুবনেশ্বর ও বেঙ্গালুরু) ওই সমীক্ষাকে হকার সংক্রান্ত গবেষণার অন্যতম প্রামাণ্য নথি ধরা হয়। প্রায় দু’দশক আগে করা ওই সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, শহরগুলির পুর কর্তৃপক্ষের হাতে হকারদের লাইসেন্স দেওয়ার
আইনি ক্ষমতা রয়েছে। ব্যতিক্রম কলকাতা! অথচ হকারদের বৈধ পরিচয়পত্র দিলে বড় সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে যেমন সম্মানজনক উপার্জনের সুযোগ দেওয়া যায়, তেমনই রাস্তা-ফুটপাত দখল হয়ে যাওয়া নিয়ে নাগরিকের ক্ষোভ প্রশমন এবং অর্থনৈতিক বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও তা সহায়ক হয়। কারণ, হকারি পেশায় যুক্ত জনগোষ্ঠীকে করের আওতায় আনা যায়। ‘ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পপুলেশন সায়েন্সেস’-এর ‘জনসংখ্যা ও উন্নয়ন’ বিভাগের অধ্যাপক অপরাজিতা চট্টোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘সামাজিক কাঠামোয় হকারি পেশাকে কেউ অস্বীকার করছেন না। কিন্তু তা বৈধ ও নিয়ন্ত্রিত না হলে এক শ্রেণিকে তুষ্ট করে হয়তো ভোটে জেতা যাবে, কিন্তু সার্বিক সামাজিক বা অর্থনৈতিক উন্নতি হবে না।’’
অথচ বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা বাদ দিলে কোনও সময়েই সে দিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ। যদিও বাম আমলে হকার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়েছিল বলে জানাচ্ছেন কলকাতার প্রাক্তন মেয়র বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য। ওই সময়ে হকার বসানোর ক্ষেত্রে বাম শ্রমিক সংগঠন সিটুর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রসঙ্গে প্রাক্তন মেয়রের বক্তব্য, ‘‘সিটু হকারদের বসায়নি। যে হকারেরা ইতিমধ্যেই বসেছেন, তাঁদের সংগঠিত করে অধিকার রক্ষায় সিটু লড়েছে।’’
এনএএসভিআই-এর সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, সাধারণ ক্রেতাদের দাবিতেই হকারেরা রয়েছেন। কারণ, নিম্ন এবং মধ্যবিত্ত আয়ের জনগোষ্ঠীর কাছে হকারদের বিকল্প কিছু নেই। তবে বেআইনি হকারের দায়িত্ব পুরসভা না পুলিশের, তা বিতর্কসাপেক্ষ বলেই মনে করছেন অনেকে। যার প্রেক্ষিতে এক পুরকর্তা বলছেন, ‘‘শিয়রে ভোট, তাই সব দোষ পুলিশের আর পুরসভা সাধু!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy