Advertisement
০৭ মে ২০২৪
Coronavirus

নৈতিকতা ভুলে আমাদের অর্জন কি এই অসংবেদনশীলতাই?

করোনাভাইরাসের সংক্রমণে আক্রান্তকে কেন অপরাধী হিসাবে গণ্য করা হচ্ছে?

বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে পরীক্ষা করাতে নিয়ে আসা হয়েছে এক বৃদ্ধকে। —ফাইল চিত্র

বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে পরীক্ষা করাতে নিয়ে আসা হয়েছে এক বৃদ্ধকে। —ফাইল চিত্র

মোহিত রণদীপ
মনঃসমাজকর্মী শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০২০ ০৫:০০
Share: Save:

দিন কয়েক আগে উত্তরবঙ্গ থেকে ফোন করেছিলেন এক বন্ধু। চা বাগানের শ্রমিকদের শিক্ষা-স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা একটি বেসরকারি সংস্থার কর্ণধার তিনি। কোভিড-১৯ আতঙ্কে তাঁর মৃত্যুভয়ের থেকে বেশি ছিল সামাজিক হেনস্থা ও বিচ্ছিন্নতার আশঙ্কা‌। যার রেশ এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি সেই বন্ধু। সেই আশঙ্কাকে সত্যি প্রমাণ করল এই মহানগরের সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা।

দিন দুই আগে সংবাদপত্রে চোখে পড়েছিল ‘হাসপাতাল-ফেরত বৃদ্ধকে করোনা-রোগী সন্দেহে মার’ শীর্ষক খবরটি। সত্তরোর্ধ্ব নারায়ণ চৌরাসিয়া দীর্ঘদিন লিভারের অসুখে আক্রান্ত। আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়া ওই বৃদ্ধ ক্লান্ত হয়ে মাঝ রাস্তায় বসে পড়েন। দু’হাতে স্যালাইনের চ্যানেল, মাথায় সার্জিক্যাল ক্যাপ, মুখে মাস্ক। ব্যস, করোনা আক্রান্ত রোগী হাসপাতাল থেকে পালিয়ে এসেছে ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়লেন স্থানীয় লোকজন। ‘করোনা হয়নি’ বলা সত্ত্বেও তাঁর জুটল মার। ওই ঘটনার পরে তিনি মাথা এবং দু’হাতে ক্ষত নিয়ে বাড়ি ফিরলেও বর্তমানে নিখোঁজ।

কয়েক দিন আগেই বিদেশ ফেরত করোনা সংক্রমিত এক আমলা-পুত্রের বেলায় দেখা গিয়েছে, সব জানা-বোঝার আগেই সংবাদমাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় নাগরিকদের বড় অংশকে ওই যুবক এবং তাঁর পরিবারের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়তে। যা গণপিটুনির থেকে কোনও অংশে কম নয়! বিদেশ ফেরত ব্যক্তিদের নাম-ছবি দিয়ে শুরু হয়ে যাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার! যদি মেনেও নিই, এই ব্যক্তিদের অনেকেই দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছেন, তা হলেও আমরা যা করছি, তা কি যুক্তিগ্রাহ্য?

এক বন্ধুর বিশেষ পরিচিত বিদেশি নাগরিককে ভাড়া বাড়ি থেকে বার করে দেওয়া হল শুধু তিনি শ্বেতাঙ্গ বলে!

একই অভিজ্ঞতা হচ্ছে এই শহরের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সদের। ‘বাড়িওয়ালা বাড়িতে ঢুকতে দিচ্ছেন না’― এমন অসহায়তার মুখোমুখি হচ্ছেন অনেকেই। চিকিৎসা পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত থাকাই তাঁদের অপরাধ! একটি অংশের ধারণা, এর মানে তাঁদের করোনা-রোগী দেখতে হচ্ছে এবং তাঁরা করোনাভাইরাস বয়ে বেড়াচ্ছেন! অর্থাৎ আমরা সবাই সংক্রমণের শিকার হব! অতএব এঁদের তাড়াও!

এমনকি করোনা-আক্রান্তের দেহ সৎকারে গিয়ে শ্মশান সংলগ্ন মানুষের বাধার মুখেও পড়তে হয়েছে প্রশাসনকে! আবার রাতের অন্ধকারে ধাপা এলাকায় দাহ করতে গিয়েও একই বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। অথচ, জলাতঙ্কে মৃত ব্যক্তিকে কখনও তো এই অবমাননার মুখোমুখি হতে হয়নি!

করোনাভাইরাসের সংক্রমণে আক্রান্তকে কেন অপরাধী হিসাবে গণ্য করা হচ্ছে? কোণঠাসা করা হচ্ছে আক্রান্তের পরিবারকে। যার জেরে পরিবারের কেউ আক্রান্ত হলে আতঙ্কিত হচ্ছেন অন্যরা। এ ক্ষেত্রে তাই সংক্রমণের থেকেও যেন সামাজিক হয়রানির আশঙ্কাই বেশি। গোপনীয়তার সব নৈতিকতা জলাঞ্জলি দিয়ে চলছে খাপ পঞ্চায়েত! আক্রান্তকে এক বারও না-দেখেই ‘বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিজ়অর্ডার’-এর ছাপ মেরে দেওয়া হচ্ছে! নৈতিকতা ভুলে আমাদের অর্জন কি এই অসংবেদনশীলতাই?

আমরা যে মানবিকতা, শিক্ষা ও সভ্যতার কথা বলি― সে সব অনেকেই হঠাৎ ভুলে গেলাম। আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর, নখ-দাঁত বার করা উন্মত্ত চেহারাই যেন আমাদের পরিচয় হয়ে দাঁড়াল! তা হলে কি বিপর্যয় আমাদের আড়াল সরিয়ে আসল চেহারা প্রকাশ করে দেয়? করোনাভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কা আজ আমাদের এই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। অন্যের অবস্থানে নিজেকে রেখে তাঁর অনুভূতি বোঝার সংবেদনশীলতা হারিয়েছি আমরা।

মানবিক বোধ, মনুষ্যত্বের আসল পরীক্ষা হয় বিপর্যয়ে, সঙ্কটে। আমাদের মানবিক সত্তা কতটা দৃঢ়, তা বুঝে নিতে পারি তখনই। এই সময়ে অনেকেরই সভ্য-ভদ্র মুখোশ নিজের অজান্তেই খসে বেরিয়ে আসে ভিতরের সঙ্কীর্ণতা, স্বার্থপরতা, হিংস্রতা। করোনাভাইরাস সংক্রমণের এই অতিমারির সময়ে এমনই কিছু অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলাম আমরা, যেখানে মনুষ্যত্বের অবমাননাই প্রকট হয়ে উঠল।

আমাদের মধ্যে স্বার্থপরতা বরাবরই ছিল। তার সঙ্গে পরার্থপরতাও ছিল। ছিল, অন্যের বিপদে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা। এমনকি নিজের ঝুঁকি সত্ত্বেও অন্যের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েন কেউ কেউ! সাম্প্রতিককালে সেই যৌথ সামাজিকতা, পাশে দাঁড়ানোর প্রবণতা চোখে পড়ার মতো কমতে শুরু করল! ‘কৃতি সংবর্ধনা পাওয়া’ গোপাল আরও সাফল্যের লক্ষ্যে ক্রমশ আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠল, আর ‘ডানপিটে’-‘বখে যাওয়া’ রাখালদের বাবা-মাও তাদের ধরে-বেঁধে ‘গোপাল’ করে তুলতে উঠে পড়ে লাগলেন!

মূলত নম্বর কেন্দ্রিক শিক্ষা যে মানবিক বোধ সম্পন্ন হয়ে ওঠার, জনস্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠার, অন্যের প্রতি সমানুভূতি প্রবণ হয়ে ওঠার শিক্ষা দিতে অপারগ, তা এই ঘটনাগুলির মধ্যে দিয়ে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Covid-19 Mohit Ranadip
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE