Advertisement
E-Paper

বাঁচতে গেলে ভুলতে হবে আড়াই লক্ষ বছরের পুরনো অভ্যাস

একসঙ্গে থাকতে শেখার দৌলতে মানুষ মানুষ হয়েছে, কিন্তু এখন বাঁচার তাগিদে তাকে একসঙ্গে না থাকা শিখতে হচ্ছে।

দেবাশিস ঘড়াই

শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০২০ ০৩:৫১
উৎসস্থল: চিনের চোউকোউ তিয়েনের একটি গুহার প্রবেশপথ। (ডান দিকে) পেকিং মানবের মডেল। প্রথম দলবদ্ধ ভাবে বাঁচতে শুরু করেছিল আধুনিক মানুষের এই পূর্বপুরুষেরাই।

উৎসস্থল: চিনের চোউকোউ তিয়েনের একটি গুহার প্রবেশপথ। (ডান দিকে) পেকিং মানবের মডেল। প্রথম দলবদ্ধ ভাবে বাঁচতে শুরু করেছিল আধুনিক মানুষের এই পূর্বপুরুষেরাই।

চিনের উহান প্রদেশ থেকে চোউকোউ তিয়েনের দূরত্ব প্রায় হাজার কিলোমিটার। প্রথম জায়গাটি কোভিড-১৯ সংক্রমণের উৎসস্থল। অন্যটি বিশ্ব হেরিটেজ সাইট। আপাতদৃষ্টিতে দুইয়ের মধ্যে কোনও যোগসূত্র নেই।

যোগসূত্র আছে, ভীষণ ভাবেই আছে— বলছেন নৃতত্ত্ববিদদের একাংশ। কারণ, এই চোউকোউ তিয়েনের একাধিক গুহা থেকেই আধুনিক মানুষের পূর্বপুরুষের (হোমো ইরেক্টাস বা পেকিং মানব) প্রথম দলবদ্ধ ভাবে থাকা, জড়ো হওয়া ও আগুন ব্যবহারের প্রমাণ মিলেছিল (অন্য মত-ও রয়েছে অবশ্য)। বিশ্ব জুড়ে হেরিটেজ এলাকা সংরক্ষণ ও ঘোষণা করে যে সংস্থাটি, সেই ‘ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অব মনুমেন্টস অ্যান্ড সাইটস’-এর তথ্য অনুযায়ী, এখান থেকেই ‘হোমিনাইজেশন’, অর্থাৎ সভ্য মানুষ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া বা অভ্যাসের শুরু। যে অভ্যাস কমপক্ষে আড়াই লক্ষেরও বেশি বছরের পুরনো। কিন্তু এক জায়গায় জড়ো হওয়ার সেই লক্ষ বছরের পুরনো অভ্যাসকেই এখন সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য সাময়িক ভাবে ভোলা (ডি-লার্ন) দরকার বলে জানাচ্ছেন গবেষকরা। মানে, একসঙ্গে থাকতে শেখার দৌলতে মানুষ মানুষ হয়েছে, কিন্তু এখন বাঁচার তাগিদে তাকে একসঙ্গে না থাকা শিখতে হচ্ছে।

দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর-গবেষক প্রকাশ মণ্ডলের কথায়, ‘‘হোমো ইরেক্টাসদের থাকার প্রমাণ আগে অন্যত্র মিললেও চোউকোউ তিয়েনের গুহাতেই প্রথম তাদের ছোট-ছোট দলে থাকার অভ্যাস, আগুন ব্যবহার ও অনুভূতিগত ভাবে জোটবদ্ধ হওয়ার প্রমাণ মিলেছিল। কমপক্ষে আড়াই লক্ষ বা তারও বেশি বছর আগে তাদের সেখানে থাকার প্রমাণ মিলেছিল।’’ যে অভ্যাস এই মুহূর্তে ভোলা প্রয়োজন বলে জানাচ্ছেন উৎকল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তথা ‘ইন্ডিয়ান অ্যানথ্রোপলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন’-এর প্রেসিডেন্ট নৃতত্ত্ববিদ সৌমেন্দ্রমোহন পটনায়েক। তাঁর কথায়, ‘‘মানুষের একসঙ্গে থাকার অভ্যাসের সূত্রপাত মা-শিশু সম্পর্কের মাধ্যমেই। কারণ, অন্য স্তন্যপায়ী প্রাণী যেখানে কিছু দিনের মধ্যেই তাদের সন্তানদের থেকে আলাদা হয়ে যায়, সেখানে মানুষই একমাত্র প্রাণী যার সন্তান মায়ের সঙ্গে দীর্ঘকাল সংযুক্ত থাকে। সেখান থেকেই সামাজিকীকরণ, এক জায়গায় জড়ো হওয়ার অভ্যাস শুরু হয়। কিন্তু সেই অভ্যাস সাময়িক ভাবে ভোলা ভাল।’’

যদিও তা ভোলা তো দূর, এখনও পাড়ার মুখে অকারণে খোশগল্প, বিনা কারণে কয়েক জন জড়ো হয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়া চলছেই।

আর নাগরিকদের একাংশের লকডাউনকে অগ্রাহ্য করার এই নিয়মভঙ্গকারী মনোভাবই ক্রমশ ‘গোষ্ঠী সংক্রমণ’-এর আশঙ্কা বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে জানাচ্ছেন গবেষকরা। তাঁরা তথ্য দিয়ে জানাচ্ছেন, ভারতে কোভিড-১৯-এর প্রথম যে ‘সিচুয়েশনাল রিপোর্ট’-টি গত ৩১ জানুয়ারি প্রকাশ করেছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু), সেখানে কেরলের তিন জনের সংক্রমণের খবর ছিল। ২১ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত চতুর্থ রিপোর্টে বলা হল, তিন জনই সুস্থ হয়ে বাড়ি চলে গিয়েছেন এবং কেরলের অবস্থা স্থিতিশীল। ২৮ ফেব্রুয়ারি, পঞ্চম রিপোর্টে সারা দেশে আর কোনও সংক্রমণের খবর নেই বলে জানাল হু।

তার পরেই প্রথম ধাক্কাটা এল ৯ মার্চ প্রকাশিত ষষ্ঠ রিপোর্টে! ১৬ জন বিদেশি-সহ ১০টি রাজ্যে সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল ৪৪। অর্থাৎ, দিনে গড়ে চার জন করে সংক্রমিত হয়েছে। সেই শুরু। তার পরে মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত ২৭টি রাজ্যে সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩৯৭ জন (কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের দেওয়া হিসেব অনুযায়ী)। অর্থাৎ এই ২২ দিনে গড়ে ৬১ জন করে সংক্রমিত হয়েছেন! এই সংখ্যা আরও বেড়ে গিয়ে যাতে কোনও ভাবেই ‘গোষ্ঠী সংক্রমণ’-এর চক্রবূহ্যে না পড়তে হয় দেশকে, তাই ঘরের চৌহদ্দির মধ্যেই থাকা দরকার বলে সতর্ক করছেন বিশেষজ্ঞেরা। না-হলে আর কোনও ভাবেই পরিস্থিতি সামলানো যাবে না বলছেন তাঁরা।

কেন্দ্রের ‘সামাজিক ন্যায় ও ক্ষমতায়ন’ মন্ত্রকের জয়েন্ট ডিরেক্টর, নৃতত্ত্ববিদ মধুমালা চট্টোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘বাড়ির লোকদের সঙ্গে কেউ সময় কাটাতে বারণ করছে না, যদি না একান্তই সংক্রমণের কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে আইসোলেশনে পাঠানো হয়। শুধু বলা হচ্ছে নিজের বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যেই থাকুন। তাতে আপনিও নিরাপদ, অন্যরাও।’’

Coronavirus India Wuhan Zhoukoudian Cave
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy