Advertisement
E-Paper

উৎসবে শহরের মন পড়ে বো ব্যারাকেই

সব্বার ছেলেমেয়েরাই কেমন লম্বা হয়ে গিয়েছে এত দিনে! আর বো ব্যারাকের এই থিকথিকে ভিড়— আগে দেখিনি তো! কোলেটের স্বামী আদতে হায়দরাবাদবাসী, কলকাতার বড়দিন-পার্বণে তত ধাতস্থ নন।

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭ ০১:২৭
পুরানো সেই: নাচে-গানে জমে উঠেছে ক্রিসমাস ইভ। রবিবার, বো ব্যারাকে। ছবি: রণজিৎ নন্দী।

পুরানো সেই: নাচে-গানে জমে উঠেছে ক্রিসমাস ইভ। রবিবার, বো ব্যারাকে। ছবি: রণজিৎ নন্দী।

মায়ের হাতের ‘রিচ প্লাম কেক’-এর স্বাদ পাল্টায়নি দশ বছরেও।

কিন্তু বৌবাজারের বো ব্যারাকের এই ভিড়ে ভিড়াক্কার চেহারা কোনও জন্মে মনে করতে পারছেন না কোলেট রাও। দশ বছর বাদে এসেছেন এখন দুবাইবাসী মহিলা। রবিবার, ক্রিসমাস ইভে ব্যারাকেই লোরেটো স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়ে গেল।

সব্বার ছেলেমেয়েরাই কেমন লম্বা হয়ে গিয়েছে এত দিনে! আর বো ব্যারাকের এই থিকথিকে ভিড়— আগে দেখিনি তো! কোলেটের স্বামী আদতে হায়দরাবাদবাসী, কলকাতার বড়দিন-পার্বণে তত ধাতস্থ নন। কার্নিভ্যাল নাইটে ইলিয়ট রোড থেকে মাকে নিয়ে ব্যারাকে এসে কোলেট ভাবছিলেন, জাঁকজমকভরা মোচ্ছব তো কতই হয়, তবে এই প্রাণশক্তিতে কলকাতাকে টেক্কা দেওয়া অসম্ভব।

শনিবার রাতের কার্নিভ্যাল নাইটে গোটা শহর উপচে পড়েছিল বো স্ট্রিটের লাল ইটে ঘেরা চিলতে উঠোনে। রাত দেড়টা অবধি ব্যারাকে বসে বসে বৃদ্ধা মেভিস রোজারিওর চোখেও উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল যৌবনের বড়দিনের ছবি। যখন বাড়িতে পার্বণী রোস্ট-কোর্মা-কেকের গন্ধে পরিবারের সবার গা ঘেঁষাঘেঁষিতে সুখ উপচে পড়ত। ক্রিসমাস ইভটা সাধারণত গির্জা থেকে বেরোতেই মাঝরাত পার হয়ে যায়। এর পরে বড়দিনটা বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে কাটানোই দস্তুর শহরের অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, গোয়ানদের। তার আগে নাচগানের কার্নিভ্যালেই ব্যারাকে উৎসবের ঢাকে কাঠি পড়ত। এ বারও পিকনিক গার্ডেন, এন্টালি, রিপন স্ট্রিট, দমদম পার্ক থেকে অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা তো বটেই, গোটা কলকাতাই জাত-ধর্ম-নির্বিশেষে জড়ো হয়েছিল। শখের ফটোগ্রাফারেরাও অনেকে ক্যামেরা হাতে ব্যারাক চত্বরে হাজির। এখন ব্যারাকের চেহারা জমজমাট মেলার মতো। ডিজে-র শব্দমুখর বিরাট মঞ্চ, চিকেন-পর্ক-মাছের রকমারি মোমো-কাবাব-রোল-ভাজাভুজির স্টল ভরপুর। আনন্দের এই হাটে তবু ঘুরেফিরে গরহাজির মুখগুলোই তাড়া করে সাবেক বাসিন্দাদের।

ভূমিপুত্রেরা কেউ কেউ ফেরেন এ মরসুমে। তবে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, বিলেতে অনেকেই ছিটকে গিয়েছেন। বো স্ট্রিটের বিখ্যাত পর্ক রোস্ট বিশারদ, বাহাত্তুরে রিচার্ড হো ইয়ুনফুর ঘোর-লাগা চাউনিও যেন সেটাই বলছিল। আগে কাছেই পোদ্দার কোর্টের প্রাত্যহিক প্রাতরাশ আসরে নিয়মিত রোস্টের পসরা নিয়ে বসতেন রিচার্ড। এখন আর পেরে ওঠেন না। স্ত্রীও মারা গিয়েছেন কয়েক বছর হল। অস্ট্রিয়া ও সিঙ্গাপুরে পাড়ি দেওয়া ছেলেমেয়ে-নাতিনাতনিদের কথা ভেবে কিছুটা যেন বিষাদ গ্রাস করছিল বৃদ্ধকে। ক্রিসমাস ইভে ভরসন্ধ্যায় ভবানীপুর থেকে সকন্যা ভাইঝি স্টেফানি, জামাই অভ্রজিৎ চৌধুরী এসে ছবিটা পাল্টে দিলেন। রিচার্ডের চোখেমুখে আবার হাজার ওয়াটের আলোর উদ্ভাস। পুঁচকে নাতনি ‘মিঠি’র দস্যিপনায় মুহূর্তে রং পাল্টাল বড়দিনের।

রিচার্ড হাসেন, ‘‘আগে ছেলেপুলেরা বছরভর খেলাধুলো, হকি-ফুটবলে মেতে থাকত, এখন অনেকেই পড়াশোনা-চাকরি নিয়ে ঢের বেশি সিরিয়াস! তবু বড়দিনের মেজাজ আছে বড়দিনেই।’’ স্রেফ অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, গোয়ান, চিনে, বাঙালি ক্রিশ্চানেরাই নন, এ তল্লাটে বড়দিন মানে সবার উৎসব। পোদ্দার কোর্টের চিনে রেস্তোরাঁর কর্তা কুচি চই, ব্যারাকের উৎসব কমিটির পাণ্ডা ফেলিক্স অগাস্টিনেরা যেমন হুল্লোড়ে আছেন, তেমনই প্রবীণ বাসিন্দা ভাগবত জানা বা হিন্দির প্রাক্তন স্কুলশিক্ষক বেনারসী লালদের কাছেও এটাই বছরের মাহেন্দ্র ক্ষণ। পাড়ার জৌলুসে জাতধর্ম নির্বিশেষে সবারই গর্বিত ময়ূর-ময়ূর ভঙ্গি।

চাঁদোয়ার মতো ঝলমলে আলোর সাজ, কাছেই দোকানে ছানার কেক ও ক্রিসমাস কেক— খামতি নেই আয়োজনে। এক বছর আগে নোট-বন্দির ধাক্কা এই পাড়ার উদ্‌যাপনকেও কিছুটা ধাক্কা দিয়েছিল। ২০১৭-র বো ব্যারাক যেন কলকাতারই আর এক নাম হয়ে উঠল।

Bow Barracks বো ব্যারাক Christmas Eve
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy