লালদিঘিতে। নিজস্ব চিত্র
এখন তো কিছু হয় না আর! বছরের শুরু থেকেই তো বন্ধ রয়েছে।
নিজের মোবাইল ঘাঁটতে-ঘাঁটতে কথাগুলো বললেন বেসরকারি সংস্থার নিরাপত্তাকর্মী। তার পরে বললেন, ‘‘দেখছেন না চার দিকের অবস্থা। অনুষ্ঠান হলে কী এরকম থাকত!’’ যেখানে দাঁড়িয়ে ওই নিরাপত্তাকর্মী কথাগুলো বলছিলেন, তার সামনেই বৃত্তাকারে স্টলগুলো করা। কোনওটার ব্যানার ছিঁড়ে পড়েছে। কোনওটার আবার প্ল্যাকার্ড খুলে পড়েছে। অনেক জায়গায় জল জমে রয়েছে। পাথরে শ্যাওলা ধরা। অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটতে গেলে যে কোনও সময়ে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
লালদিঘির পাড়ে কলকাতা পুরসভা আর রাজ্য সরকারের পর্যটন দপ্তরের যৌথ উদ্যোগে স্থায়ী উৎসব ‘দেখো রে’ চালু হয়েছিল গত বছর। এই উৎসবের মূল উদ্দেশ্য ছিল, প্রতি শনিবার ও রবিবার বিকেলে লালদিঘিতে একটা আড্ডার পরিবেশ গড়ে তোলা। ওখানে তৈরি মঞ্চে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হত সপ্তাহান্তে। সেই সঙ্গে লালদিঘির পাড়ে গড়ে ওঠা অস্থায়ী দোকানে নামী প্রতিষ্ঠানের বিরিয়ানি, চাউমিন থেকে বাংলার প্রসিদ্ধ সন্দেশ, ল্যাংচা, রসগোল্লায় রসনাতৃপ্তি। কিন্তু প্রথম কয়েক মাস চলার পরেই তা বন্ধ হয়ে যায়। চলতি বছরের শুরু থেকেই ওই অনুষ্ঠান পুরোপুরি বন্ধ। কবে চালু হবে ফের সে সম্পর্কেও ধোঁয়াশা রয়েছে। এক নিরাপত্তারক্ষীর কথায়, ‘‘বর্ষা কাটলে চালু হবে হয়তো। কবে তা আমরা জানি না!’’
এজেন্সি নিয়োজিত ওই নিরাপত্তারক্ষীর তা জানার কথাও নয় অবশ্য! সূত্রের খবর, গ্রেড ওয়ান হেরিটেজ তালিকাভুক্ত লালদিঘিতে পরিবর্তনের যে অনুমোদন পুরসভার হেরিটেজ কমিটি গত বছরের অগস্টে দিয়েছিল (যে কারণে চলতি বছরের শুরুতেই লালদিঘিতে নতুন শৌচালয় ও পানীয় জলের বুথ তৈরি করা হয়েছে) সেই অনুমোদন মেয়র পারিষদের বৈঠকে প্রস্তাব হিসেবে পাশ করা হয়েছে গত মাসে! অর্থাৎ, অনুমোদন দেওয়ার প্রায় এক বছর পরে তা বৈঠকে পাশ হচ্ছে! যেখানে লালদিঘির মতো ঐতিহ্যবাহী এলাকার ক্ষেত্রে সামান্য পরিবর্তন হলেও তা সঙ্গে সঙ্গে জানার কথা, এ ক্ষেত্রে শুধু নিয়মমাফিক ‘পোস্ট-ফ্যাক্টো অ্যাপ্রুভাল’ নেওয়া হচ্ছে বলে সমালোচনায় মুখর হেরিটেজ বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
তাঁদের বক্তব্য, লালদিঘির মতো ঐতিহ্যবাহী এলাকায় সামান্য পরিবর্তন করতে হলেও পদে-পদে সচেতন থাকার দরকার। সেখানে পুরসভার হেরিটেজ কমিটির অনুমোদন এক বছর পরে কেন মেয়র পরিষদের বৈঠকে তোলা হল! এক হেরিটেজ বিশেষজ্ঞের কথায়, ‘‘লালদিঘির মতো এলাকার ক্ষেত্রে পোস্ট ফ্যাক্টো অ্যাপ্রুভাল কতটা প্রাসঙ্গিক তা ভাবতে হবে! কারণ, বৈঠকে যখন প্রস্তাবটি পাশ হচ্ছে, তার অনেক আগেই সেখানে একটা স্থায়ী পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে! ফলে তখন সেই প্রস্তাব পাশের কোনও অর্থ থাকে না!’’
ইতিহাস বলছে, ব্রিটিশ কলকাতা বা ‘হোয়াইট ক্যালকাটা’র মূল ভরকেন্দ্রই তো ছিল ডালহৌসি স্কোয়ার। ১৯১০ সাল পর্যন্ত এই এলাকাই ছিল ব্রিটিশদের প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক কাজকর্মের মূল আধার। ১৭০৯ সালে লালদিঘিও তৈরি হয়েছিল ‘সাহেবদের কলকাতা’য় পানীয় জল সরবরাহের কারণে। জনশ্রুতি, শহরের মধ্যে সবথেকে মিষ্টি ছিল এই লালদিঘির জল। ১৮২৭ ও ১৮৪৮ সালে এই লালদিঘিতে ঘড়িয়ালও ধরা পড়েছিল এমন তথ্যও আছে। কিন্তু সে সব ঐতিহ্যের কিছুই এখন অবশিষ্ট নেই! এক হেরিটেজ বিশেষজ্ঞের কথায়, ‘‘একটা অনুষ্ঠান চালু করা হল। অথচ তা বন্ধ হয়ে গেল। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছাড়াই হেরিটেজ এলাকার সবকিছু পাল্টে গেল!’’
তবে কলকাতা পুরসভা জানাচ্ছে, বর্ষার কারণে আপাতত লালদিঘির পাড়ের অনুষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। ফের তা চালু হবে। লালদিঘির নিরাপত্তার জন্য তিন শিফটে প্রায় ৩০ জন নিরাপত্তারক্ষী রয়েছেন। এলাকার যাতে কোনও ক্ষতি না হয়, তাঁরাই দেখভাল করছেন। এক পুরকর্তার কথায়, ‘‘ওখানকার দর্শকদের কথা ভেবেই জলের বুথ আর শৌচালয় তৈরি করা হয়েছে। আর যা কিছু করা হয়েছে তা পুর হেরিটেজ কমিটির অনুমতি নিয়েই করা হয়েছে। মেয়র পরিষদের বৈঠকে প্রস্তাব হয়তো একটু দেরিতেই পাশ হয়েছে, কিন্তু তা হতেই পারে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy