Advertisement
E-Paper

নাডু-কেক-বিরিয়ানিতে বেঁধে রাখে সম্প্রীতি

সেই কাকভোরে ঘুম ভাঙে আজানের সুরে। দিনের আলো ফুটতেই পাড়ার শিবমন্দির থেকে ভেসে আসা আরতির ঘণ্টা, কিংবা সেন্ট ইগনেশিয়াস গির্জায় সকালের প্রার্থনার সুর। আমার পাড়া যেন ভারতবর্ষের ক্ষুদ্র সংস্করণ। হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টানের পারস্পরিক ভালবাসাই আমাদের এই একবালপুর লেনের অহঙ্কার।

আশিস মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০১:০৬
ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য

ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য

সেই কাকভোরে ঘুম ভাঙে আজানের সুরে। দিনের আলো ফুটতেই পাড়ার শিবমন্দির থেকে ভেসে আসা আরতির ঘণ্টা, কিংবা সেন্ট ইগনেশিয়াস গির্জায় সকালের প্রার্থনার সুর। আমার পাড়া যেন ভারতবর্ষের ক্ষুদ্র সংস্করণ। হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টানের পারস্পরিক ভালবাসাই আমাদের এই একবালপুর লেনের অহঙ্কার।

পাড়া মানে শুধু থাকার জায়গা তো নয়! বরং আশপাশের মানুষ, তাঁদের জীবিকা, চিন্তাধারা এবং অভিব্যক্তি— সবটা নিয়েই গড়ে ওঠে পাড়ার নিজস্বতা। এক পাশে ময়ূরভঞ্জ রোড, আর এক দিকে একবালপুর রোড। তারই মাঝে এ পাড়াটা আপাতদৃষ্টিতে একেবারেই আকর্ষণীয় বা ঝাঁ-চকচকে নয়। তবু দিনযাপন আর আন্তরিকতার টান ভরপুর।

আগে থাকতাম মুম্বইয়ে। বছর কুড়ি আগে যখন এলাম, শুরুর দিনগুলোয় পাড়াটাকে বড্ড বিবর্ণ আর মলিন লাগত। তখন রাস্তাঘাট অপরিচ্ছন্ন, পানীয় জলের অভাব, তার উপরে একটু বৃষ্টিতেই জল জমত। দিন বদলের সঙ্গে এলাকার এই সার্বিক ছবিটা বদলেছে। রাস্তাঘাট পরিচ্ছন্ন থাকে। নিয়ম করে হয় জঞ্জাল সাফাই, মশার তেল ও ব্লিচিং ছড়ানো। রাতে জোরালো আলোয় পাড়াটার রূপও খুলেছে।

এলাকার উন্নতি হয়েছে রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম এবং স্থানীয় কাউন্সিলরের উদ্যোগে। পানীয় জলের জোগান এখন পর্যাপ্ত। নিকাশি ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় কমেছে বৃষ্টিতে জল জমার সমস্যাটাও কেটে গিয়েছে। শান্তিপূর্ণ, নির্ঝঞ্ঝাট এই পাড়ায়
নানা ভাষা, নানা ধর্মের লোকের মিলেমিশে বাস।

বেশ কয়েক বছর ধরে পাড়ায় দ্রুত বেড়েছে শিক্ষার হার। এলাকার মানুষের একটা বড় অংশ আজ স্বনির্ভরশীল। স্বাস্থ্য পরিষেবাতেও আমাদের পাড়াটা এগিয়ে। কাছাকাছি রয়েছে তিনটি হাসপাতাল এবং কয়েকটি নার্সিং হোম। রয়েছে সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রও। স্থানীয় কয়েকটি ক্লাবের উদ্যোগে হয় রক্তদান ও স্বাস্থ্য শিবির, ছোটদের বসে আঁকো প্রতিযোগিতা, দুঃস্থদের মধ্যে বস্ত্র বিতরণ। পাশাপাশি, বস্তিবাসীদের উন্নয়নের জন্য প্রতি বছর একটি স্কুলের উদ্যোগে প্রায় চল্লিশ জন দুঃস্থ ছাত্রকে অনুদান দেওয়া হয়।

অতীতে কাছেই ছিল ময়ূরভঞ্জের রাজবাড়ি। সেখানে এখন তৈরি হয়েছে কলেজ। এখানে পার্কিং সমস্যা ততটা প্রকট নয়। কাছেই একবালপুর বাজারে সব কিছুই পাওয়া যায় মধ্যবিত্তের নাগালের মধ্যে।

পাড়ায় খেলাধুলোর ছবিটা অবশ্য অপরিবর্তিত। আমার বাড়ির কাছেই নবাব আলি পার্ক স্টেডিয়াম। প্রতি দিন ভোরে সেখানে অনুশীলন চলে। খেলাধুলোর পাশাপাশি নিয়মিত ব্যায়াম ও ক্যারাটের প্রশিক্ষণও হয়। এলাকার সব স্কুল ও কলেজের ক্রীড়া প্রতিযোগিতাও হয় এখানেই।

আমাদের আবাসনটিও একটি যৌথ পরিবারের মতো। হিন্দু-মুসলিম সবাই মিলেমিশে থাকা— দুর্গাপুজোও যেমন সবাই মিলেই উদ্‌যাপন করেন, তেমনই ঈদের খুশিতেও সামিল হন সকলেই। কাছেই নবাব আলি পার্ক আর অলিগলিতে বেশ কিছু পুজো হয়। একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া, আড্ডা তো আছেই, সেই সঙ্গেই চলে নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও।

পাড়ায় আড্ডার ঠিকানা কাছের পার্কটা। সকাল-সন্ধ্যায় নানা বয়সের মানুষ গল্পগুজবে মাতেন। কেউ কেউ আবার সকাল-সকাল বাড়ির সামনে খবরের কাগজ পড়তে বসেন। ফাঁকে ফাঁকে চলে টুকটাক গল্পও।

কোনও সমস্যা নেই বলা যাবে না অবশ্য। এ পাড়ায় একটা বড় সমস্যা রাত বাড়তেই নেশাগ্রস্তদের আনাগোনা। যুব সমাজের একাংশে দেখি এখন মাদকাসক্তি বেড়েছে।
তবে বেশ কিছু সংস্থা এদের পুনর্বাসনের পাশাপাশি জীবনের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছে।

কিন্তু এতগুলো বছরে এই পাড়াটা আমার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গিয়েছে। শহরের অন্যত্র কোথাও থাকার সুযোগ এলেও বোধহয় এ পাড়া ছেড়ে যাব না। এটাই হয়তো ভালবাসা। দুর্গাপুজোর নারকেল নাড়ু, ইদের বিরিয়ানি আর বড়দিনে কেক— এই মিলমিশটাই বাঁচিয়ে রাখবে এ পাড়ায়।

লেখক ক্যানসার চিকিৎসক

harmony
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy