হোটেল তোমার তো মাঠ আমার। হায়াত রিজেন্সি তোমার তো যুবভারতী আমার। দুই মন্ত্রী সুজিত বসু এবং অরূপ বিশ্বাসের ‘মেসি দখলের’ লড়াইয়েই শনিবারের যুবভারতী বিপর্যয় ঘটেছে। যে বিপর্যয় বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে সরকার, পুলিশ-প্রশাসন এবং সামগ্রিক ভাবে শাসক তৃণমূলের সংগঠনকেও। বিপর্যয়ের মাত্রা এমনই যে, প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হয়েছে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে।
সুজিত ‘ক্রীড়ামনস্ক’। অরূপ ‘ক্রীড়ামন্ত্রী’। কলকাতায় কোনও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ক্রীড়াবিদ আসবেন আর সুজিত তাঁকে কড়া ‘ম্যানমার্কিং’ করবেন না, তা হয় না। অধুনা দমকলমন্ত্রী সুজিত একদা ছিলেন সুভাষ চক্রবর্তীর ক্রীড়াশিষ্য। সুভাষ ক্রীড়ামন্ত্রী থাকাকালীনই ক্রীড়ার বিষয়ে সুজিতের বুৎপত্তি মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত। অরূপও কম যান কিসে! তিনি রাজ্যের ক্রীড়ামন্ত্রী। খাওয়াদাওয়ার পরিমাণ কমিয়ে মেদ ঝরানোয় মন দিয়েছেন। যাতে দৌড়ঝাঁপের সময় হাঁফ না ধরে। ডুরান্ড কাপ শুরু করিয়েছেন কলকাতায়। তাঁর আমলেই অনূর্ধ্ব ১৭ পুরুষ বিশ্বকাপের আয়োজন হয়েছিল যুবভারতীতে। তা প্রশংসিতও হয়েছিল। ফলে কলকাতায় আগত যে কোনও ক্রীড়াব্যক্তিত্বের উপর তাঁর তো একটা ‘প্রাতিষ্ঠানিক অধিকার’ থাকবেই।
দুষ্টু লোকে অবশ্য বলছে, খেলার পাশাপাশিই আরও একটি বিষয়ে সুজিত-অরূপ লড়াই আছে— পুজো। সুজিতের শ্রীভূমি বনাম অরূপের সুরুচি। কার পুজো কত লোক টানল, কার পুজোর কোন তারকা গেলেন, তা নিয়ে একটা সূক্ষ্ণ প্রতিযোগিতা দু’জনের মধ্যে আছে। সে যতই দু’জনের পুজো শহরের মানচিত্রের দুই প্রান্তে হোক না কেন।
মেসি-দখলের সূত্রপাত শুক্রবার গভীর রাতে। বিশ্ব ফুটবলের মহাতারকা কলকাতা বিমানবন্দরে পা রাখার পরেই তাঁকে নিজের ‘দখলে’ নিয়ে ফেলেছিলেন সুজিত। বাইপাসের পাশের হোটেল হায়াত রিজেন্সিতে পৌঁছোনো থেকে শনিবার সকাল ১১টা ২৫ পর্যন্ত মেসি ছিলেন সুজিতের ‘হেফাজতে’। যেখানে ঘেঁষতে পারেননি (মতান্তরে, ঘেঁষতে দেওয়া হয়নি) অরূপ। হায়াতে সুজিত সপরিবারে ছিলেন। তাঁর পরিবার ছিল। ছিলেন তাঁর পছন্দের বাছাই লোকজনও। নিজের ক্লাব শ্রীভূমির সামনে মেসির ৭০ ফুটের মূর্তি উন্মোচন করানো থেকে বিশ্বকাপজয়ী আর্জেন্তিনীয় তারকার সঙ্গে আলাপচারিতা— সবেতেই সুজিত সামনে। সক্রিয়। রসিকতা করে অনেকে বলছেন, সুজিত নাকি মোবাইলে স্প্যানিশ ভাষা অনুবাদ করে মেসির একটা ছোট সাক্ষাৎকারও নিয়েছেন!
প্রথম ল্যাপে অতএব, দৌড়ে খানিকটা পিছিয়ে ছিলেন অরূপ। কিন্তু তিনি লম্বা রেসের ঘোড়া। হোটেলে জায়গা না পেলে কী আছে? মাঠ তো আছে! গ্যালারিতে হাজার হাজার দর্শক আছে। জনতার সামনে মেসির দখল নিতে পারলে হোটেলের নিভৃতিতে সুজিত কী করলেন, তা নিয়ে আর কে মাথা ঘামাবে! সুতরাং মেসি মাঠে ঢুকতেই অরূপ দলবল-সহ ঘিরে ফেলেন তাঁকে। যে বলয়ে ছিলেন উদ্যোক্তাদের অনেকে এবং কলকাতা ময়দানের সঙ্গে যুক্ত কর্তা, ফুটবলার, প্রাক্তন ফুটবলার এবং টলিউডের পরিচিত মুখেরা। যাঁদের উপর অরূপের ‘নিয়ন্ত্রণ’ সর্বজনবিদিত।
হোটেলে সুজিতের ময়দানে কোনও গণজমায়েত ছিল না। সেখানে ছিলেন বাছাই ফলে মেসিকে নিয়ে আকুলতাও প্রকাশ্যে আসেনি। বিপর্যয়ও ঘটেনি। যা ঘটেছে খোলা মাঠে। গ্যালারির চোখের সামনে। ফলে সুজিতের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষোভ তৈরি হয়েছে অরূপকে নিয়ে। অরূপের সঙ্গেই মাঠে ঢুকেছিলেন তৃণমূলের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষা ভাবে জড়িতেরাও। যাঁরা দল এবং প্রশাসনের অন্দরে বিভিন্ন কারণে ‘বিশেষ গুরুত্ব’ পেয়ে থাকেন।
দুই অর্ধে দুই ছবি
ফুটবলে ৪৫ মিনিট করে দু’টি অর্ধে খেলা হয়। মেসিকে ঘিরে যুবভারতীতেও শনিবার দু’টি অর্ধ হল। তবে প্রথমটি ২২ মিনিটের, পরেরটি ৬৩ মিনিটের। ২২ মিনিট জুড়ে ছিল ‘উৎসব’। আর ৬৩ মিনিটের পুরোটাই ‘তাণ্ডব’। মেসি মাঠে ঢোকেন সকাল সাড়ে ১১টা নাগাদ। তাঁর ‘মহানিষ্ক্রমণ’ ১১টা ৫০ নাগাদ। যে ২০ মিনিট তাঁকে ঘিরে ছিলেন অরূপের মতো শ’খানেক লোক। যাঁকে দেখতে জনতা হাজার হাজার টাকা খরচ করে মাঠে এল, তিনিই ঢাকা পড়ে গেলেন! মেসির গাড়ি মাঠ ছেড়ে বাইপাস ছোঁয়ার আগেই শুরু তাণ্ডব। ক্রোধের আস্ফালন। বেলা ১টা নাগাদ সেই তান্ডব খানিক স্তিমিত হয়। গোটা যুবভারতী সাক্ষী যে, প্রথম ২২ মিনিট মেসিকে নিয়ে পাড়ার স্তরের অব্যবস্থা না হত, পরের ৬৩ মিনিট ঘটতই না।
আত্মসমর্পণ পুলিশের
সাধারণত ফুটবল মাঠের গ্যালারিতে গণ্ডগোল শুরু হলেই পুলিশ এবং র্যাফ গ্যালারিতে উঠে লাঠিচার্জ শুরু করে। ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর যুবভারতীতে বিরাট গণ্ডগোল সে ভাবেই ঠেকিয়েছিল পুলিশ। কিন্তু শনিবার ফেন্সিং ভেঙে চার দিক থেকে ক্রুদ্ধ জনতা ঢুকে পড়তে থাকে মাঠে। পুলিশ প্রথমে আটকানোর চেষ্টা করলেও পারেনি। লাঠি নিয়ে তেড়ে গেলও পিছ হটতে হয় বাহিনীকে। একাধিক বার পুলিশকে ঘিরে ফেলে জনতা। মারধরও দেয়। পিছু হটতে হয়েছে পুলিশের বড়কর্তাদেরও। দীর্ঘদিন পরে হাতে লাঠি তুলতে হল আইজি (আইন-শৃঙ্খলা) জাভেদ শামিমকে। গোটা মাঠ জুড়ে যখন জনতা নানা ভাবে তাণ্ডব চালাচ্ছে, তখন আবার এক দল পুলিশ শীতের মিঠে রোদ পিঠে মেখে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে। তবে সাংবাদিকদের একটি উপকার পুলিশকর্মীরা করেছেন। প্রেস বক্সে এসে তাঁরা সাবধান করে দিয়ে গিয়েছেন, ‘‘গলায় ঝোলানো অ্যাক্রিডিটেশন কার্ডটা খুলে পকেটে নিয়ে মাঠ থেকে বেরোন। ওটা দেখলেই লোকে শতদ্রু দত্তের লোক বলে পেটাবে!’’
আরও পড়ুন:
বেতাল বোতল
যুবভারতীতে এখন কোনও ধরনের ব্যাগ বা জলের বোতল নিয়ে ঢোকা নিষিদ্ধ। জলের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা থাকে ওয়াটার পাউচে। যে পরিমাণ বোতল মাঠে উড়ে এসে পড়ল, তা কোথা থেকে এল? উত্তর, গ্যালারির ভিতর থেকে। গ্যালারিতে জলের বোতল বিক্রি করা হয়েছে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক চড়া দামে। ভিতরে বোতল বিক্রির অনুমতি কেন দেওয়া হল? কেনই বা তা চড়া দামে বিক্রি করা হল? এই ধরনের বড় ‘ইভেন্ট’ যে সংস্থাই করুক, তারা সরকারের সঙ্গে সমন্বয় রাখে। শনিবারের যুবভারতী কেলেঙ্কারি প্রশ্ন তুলে দিয়েছে, আদৌ সরকারের সঙ্গে শতদ্রু দত্তদের কোনও সমন্বয় ছিল কি? বিশেষত, যে মঞ্চে রাজযের মুখ্যমন্ত্রীর থাকার কথা? থাকলে কী করে এই বিপর্যয় ঘটল? না থাকলে প্রশাসন যুবভারতীতে এই সফর করার অনুমতি দিল কেন?
আধলায় ভাঙল গেট
যুবভারতীর ফেন্সিং টপকানো নিয়মিত মাঠে যাওয়া সমর্থকদের কাছে কষ্টসাধ্য নয়। কিন্তু সেই ঝুঁকি না নিয়ে ফেন্সিংয়ের লোহার ছিটকিনি ভাঙা হয়েছে আধলা ইট দিয়ে। প্রথমে দু’নম্বর গ্যালারিতে। তার পর ক্রমে ভিআইপি, চার নম্বর এবং পাঁচ নম্বর গ্যালারিরও গেটের ছিটকিনি ভাঙা হয়েছে। চতুর্দিক দিয়ে মানুষের স্রোত ঢুকে পড়েছে মাঠে। তার পরে গোটা মাঠ তাদেরই দখলে চলে গিয়েছিল। তার যথেচ্ছ ভাঙচুর করেছে। উপড়ে নিয়েছে মাঠের ঘাস, গ্যালারির চেয়ার। তুলে নিয়েছে ফুলগাছ-সহ টবও।
মাঠে গেরুয়া পতাকা, জয় শ্রীরাম
তাণ্ডবের সময়ে দেখা যায়, তিন নম্বর এবং দুই নম্বর গ্যালারির দিক থেকে দু’জন দু’টি গেরুয়া পতাকা নিয়ে মাঠের মাঝখানে চলে এসেছেন। সেই দুই যুবককে ঘিরে দেখা যায়, এক দঙ্গল লোক জয় শ্রীরাম স্লোগান দিচ্ছেন। তৃণমূলের বক্তব্য, বিজেপি গেরুয়া পতাকা গাতে দিয়ে লোক ঢুকিয়ে গোলমাল পাকিয়েছে। উল্টো দিকে, বিজেপির বক্তব্য, এর সঙ্গে তাদের কোনও সম্পর্কই নেই। তৃণমূলই নজর ঘোরাতে গেরুয়া পতাকা হাতে ধরিয়ে এই কাণ্ড ঘটিয়েছে।
গেরুয়া পতাকা হাতে মাঠে ঢুকে পড়েন দুই যুবক। —নিজস্ব চিত্র।
১৪ জনের ফুটবল
যুবভারতীতে মেসির অনুষ্ঠানের অন্যতম অংশ ছিল মোহনবাগনের তারকা একাদশ বনাম ডায়মন্ড হারবার একাদশের প্রদর্শনী ম্যাচ। সেই ম্যাচে দু’দলে খেলেছেন ১৪ জন করে। মাঠে রেফারি-সহ ছিলেন ২৯ জন! রেফারি-সহ প্রত্যেকের জার্সির পিছনে লেখা ‘মেসি’। ফুটবলারদের জার্সির সামনেও মেসির মুখের ছবি। যা অনাবিল হাস্যরস যুগিয়েছে। সেই ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধ শুরু হওয়ার দু’মিনিটের মধ্যেই অবশ্য মাঠে ঢুকে পড়ে মেসির গাড়ি। লম্বা বাঁশি বাজিয়ে রেফারি জানিয়ে দেন, খেলা শেষ।
আসলে তখন খেলা শেষ নয়, তখন যুবভারতীতে খেলা শুরু!