Advertisement
E-Paper

বিশ্বমঞ্চে কলকাতার মাথা হেঁট! মেসিকে ঘিরে থাকা অযোগ্য কর্তা ও নেতারা প্রমাণ করলেন, এ শহর বড় ‘ইভেন্ট’ সামলাতে অপদার্থ

দর্শকদের ক্ষোভ শুধু যুবভারতীকে লন্ডভন্ড করেই থামল না, গোটা দেশের কাছে, এমনকি, গোটা বিশ্বের কাছেও লজ্জায় ফেলে দিল কলকাতাকে। এ শহর যে এমন অনুষ্ঠানের জন্য উপযুক্ত নয়, প্রমাণ করে ছাড়লেন শহরের নেতা-মন্ত্রী-কর্তারা।

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৫:৫৪
লিয়োনেল মেসি মাঠ ছাড়ার পর তছনছ যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন। পুলিশের সঙ্গে দর্শকের ধস্তাধস্তি। শনিবার।

লিয়োনেল মেসি মাঠ ছাড়ার পর তছনছ যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন। পুলিশের সঙ্গে দর্শকের ধস্তাধস্তি। শনিবার। ছবি: পিটিআই।

লিয়োনেল মেসির সফর বিশ্ব দরবারে মাথা হেঁট করে দিল কলকাতার। লন্ডভন্ড হল শহরের বৃহত্তম ফুটবল স্টেডিয়াম যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন। হাজার হাজার দর্শকের ক্ষোভ আছড়ে পড়ল সল্টলেক স্টেডিয়াম এবং লাগোয়া এলাকায়। তুমুল বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে মাঝপথ থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে ফিরে যেতে হল মুখ্যমন্ত্রীকে। এ ঘটনা নজিরবিহীন। প্রকাশ্যে ক্ষমাপ্রার্থনাও করতে হল তাঁকে। এমন ঘটনাও সাম্প্রতিক কালে ঘটেছে কি না, কেউ মনে করতে পারছেন না। মেসির সঙ্গে যাঁর মাঠে আসার কথা ছিল, সেই শাহরুখ খান হোটেল থেকেই ফিরে গেলেন।

ঘটনা যে দিকে যাচ্ছিল, তাতে অনেকের বেঙ্গালুরুর কথা মনে পড়েছে। প্রথম বার আইপিএল জেতার পর বিরাট কোহলিদের সংবর্ধনার অনুষ্ঠানে ভিড়ের চাপে পদপিষ্ট হয়ে ১১ জনের মৃত্যু হয়েছিল সেখানে। যুবভারতীতে অবশ্য পরিস্থিতি তত খারাপ হয়নি। কিন্তু ঘটনার পর লুটপাট হয়েছে। শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ছাড়ার পর যেমন তাঁর বাসস্থান ‘গণভবন’ থেকে জিনিসপত্র লুট হয়েছিল, সে ভাবেই বিধ্বস্ত যুবভারতী থেকে কেউ তুলে নিয়ে গিয়েছেন ফুলের টব। কেউ ছিঁড়ে নিয়ে গিয়েছেন মাঠের ঘাস।

যুবভারতী থেকে ফুলের টব নিয়ে যাচ্ছেন এক দর্শক।

যুবভারতী থেকে ফুলের টব নিয়ে যাচ্ছেন এক দর্শক। —নিজস্ব চিত্র।

এমন কলঙ্কিত দিন সাম্প্রতিক অতীতে কলকাতার ইতিহাসে আসেনি। হাজার হাজার টাকা দিয়ে মেসিকে দেখার জন্য টিকিট কেটেছিলেন দর্শকেরা। কেউ দিয়েছিলেন ১২ হাজার টাকা। কেউ ১৬ হাজার। কিন্তু তাঁরা এক ঝলকেও দেখতে পাননি বিশ্বজয়ী ফুটবলারকে। ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ জনতার কারও কথায়, ‘‘আমাদের সঙ্গে একটা বড় দুর্নীতি হল। টাকা ফেরত চাই।’’ পরিস্থিতি এমনই অগ্নিগর্ভ ছিল যে, অনেক দর্শক সারদা কেলেঙ্কারির কথা টেনে এনে মেসির সফরের মূল উদ্যোক্তা শতদ্রু দত্তের তুলনা করতে শুরু করেন সারদাকর্তা সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে। কেউ বলেন, ‘‘মেসিকে তো দেখতে পেলামই না, বদলে কয়েক জন ক্রিমিনালকে দেখতে হল!’’

এই ক্ষোভের আগুন শুধু যুবভারতীকে লন্ডভন্ড করেই থামেনি। গোটা বিশ্বের কাছে লজ্জায় ফেলে দিয়েছে কলকাতাকে। কারণ, মেসি আন্তর্জাতিক ক্রীড়াব্যক্তিত্ব। তাঁকে ঘিরে শনিবার ‘যুবভারতী কেলেঙ্কারি’ প্রমাণ করে দিয়েছে যে, এ শহর এমন ‘ইভেন্ট’ আয়োজনের আদৌ উপযুক্ত নয়।

মাথা বাঁচাতে দর্শকদের ভাঙা চেয়ার ঢাল করেছেন এক পুলিশকর্মী। শনিবার যুবভারতীতে।

মাথা বাঁচাতে দর্শকদের ভাঙা চেয়ার ঢাল করেছেন এক পুলিশকর্মী। শনিবার যুবভারতীতে। ছবি: পিটিআই।

শুক্রবার রাতেই কলকাতায় চলে এসেছিলেন মেসি। সঙ্গে ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু তথা বিশ্ব ফুটবলের আরও দুই তারকা লুইস সুয়ারেজ় এবং রদ্রিগো ডি’পল। রাত আড়াইটে নাগাদ মেসির বিমান নামার পর কলকাতা বিমানবন্দরে ভক্তদের ভিড় এবং উন্মাদনা ছিল চোখে পড়ার মতো। সেই উন্মাদনা যে এমন ক্রোধের বিস্ফোরণ ঘটাবে, তা তখন আন্দাজ করা যায়নি। মেসিকে দেখতে না পেয়ে রাগে স্টেডিয়ামের চেয়ার ভেঙেছেন দর্শকেরা। ভাঙা চেয়ার, বোতল ছুড়েছেন মাঠে। পুলিশের ব্যারিকেড, ফেন্সিং ভেঙে হাজারে হাজারে দর্শক ঢুকে পড়েন মাঠে। মাঠে আগুন লাগিয়ে দেওয়ারও চেষ্টা হয়েছে! ফুটবলের রাজপুত্রকে শহর ছাড়তে হয়েছে বিক্ষোভের অস্বস্তি নিয়েই।

গ্যালারি থেকে উড়ে আসছে ভাঙা চেয়ার। শনিবার যুবভারতীতে।

গ্যালারি থেকে উড়ে আসছে ভাঙা চেয়ার। শনিবার যুবভারতীতে। —নিজস্ব চিত্র।

দর্শকদের ক্রোধ ‘অনৈতিক’ নয়। যুবভারতীতে মেসির সফর ঘিরে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল, সেখানে সবচেয়ে সস্তার টিকিটের দামই ছিল চার হাজার টাকার উপর। বিশ্বজয়ী ফুটবলারকে সামনে থেকে এক বার চোখের দেখা দেখবেন বলে ভক্তেরা টিকিটের দামে বাছবিচার করেননি। কেউ ১০ হাজার, কেউ ১৫ হাজার, কেউ ৩০ হাজার টাকা দিয়েও টিকিট কেটেছেন। ভেঙে ফেলেছেন কয়েক বছরের সঞ্চয়! কিন্তু মেসির এক ঝলকও দেখতে পেলেন না গ্যালারি থেকে। মাঠে যতটুকু সময় মেসি ছিলেন, তাঁকে ঘিরে রাখা হয়েছিল। মেসি এমনিতেই ছোটখাটো চেহারার। তার উপর তাঁকে ঘিরে রেখেছিলেন কিছু রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রী, সাংবাদিক এবং নিরাপত্তারক্ষী। ছিলেন ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, মোহনবাগান কর্তা সৃঞ্জয় বসুরা। তাঁরা মেসিকে দেখেছেন। তাঁর সই নিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে নিজস্বীও তুলেছেন। দর্শকেরা কোথায়! ‘টলিউডের প্রতিনিধি’ হিসাবে মেসির সঙ্গে দেখা করারা সুযোগ পেয়েছিলেন শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়। মেসি, ডি’পলদের সঙ্গে ছবি তিনি নিজের সমাজমাধ্যমে পোস্ট করেছেন। নীচে ভেসে এসেছে কটাক্ষ, ‘ভালই তো দর্শকদের টাকায় নিজেরা ফুটেজ নিয়ে এলে।’ যুবভারতীর বাইরে দর্শকেরা আওয়াজ তোলেন, ‘‘যারা ফুটবলের ‘ফ’ বোঝে না, তারা মেসির কাছে থাকল। আমরা পয়সা দিয়েও কিছু পেলাম না।’’

লিয়োনেল মেসি, লুইস সুয়ারেজ়দের সঙ্গে শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়।

লিয়োনেল মেসি, লুইস সুয়ারেজ়দের সঙ্গে শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়। ছবি: ফেসবুক।

যুবভারতীতে মেসি থাকতে পেরেছেন সাকুল্যে ১৬ থেকে ১৮ মিনিট। কিছু ক্ষণ মাঠে ঘোরাফেরা করার পরেই তাঁকে বেরিয়ে যেতে হয়। অনেকের দাবি, দর্শকদের ক্ষোভ এবং ক্রোধের আঁচ পেয়েই তড়িঘড়়ি মাঠ থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছিল মেসিকে। নির্ধারিত সময়সূচি বলেছিল, মেসি আরও বেশ কিছু ক্ষণ যুবভারতীতে থাকবেন। তাঁর সঙ্গে একই মঞ্চে থাকার কথা ছিল মমতা, শাহরুখ খান এবং সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের। বেলা ১২টা নাগাদ মুখ্যমন্ত্রী মমতার পৌঁছোনোর কথা ছিল যুবভারতীতে। পরিস্থিতি দেখে মমতা আর মাঠের দিকে এগোননি। মাঝপথ থেকে তিনি ফিরে যান।

মেসি মাঠ ছাড়তে না ছাড়তেই যুবভারতীতে শুরু হয় দর্শক-তাণ্ডব। মেসিকে কলকাতা তথা ভারত সফরে নিয়ে আসার নেপথ্যে প্রধান ভূমিকা ছিল শতদ্রু দত্তের। তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দেন দর্শকেরা। তাঁদের বলতে শোনা যায়, ‘‘শতদ্রুকে টাকা ফেরত দিতে হবে। লাইভে এসে ক্ষমা চাইতে হবে।’’ ক্ষোভের নিশানায় পড়েন ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপও। মাঠে ১৫ মিনিট কার্যত মেসির বাহুলগ্ন হয়েই ছিলেন তিনি। এক মুহূর্তের জন্য তাঁকে মেসির থেকে বিচ্ছিন্ন হতে দেখা যায়নি। তাঁদের ঘিরে থেকেছে আরও জটলা। ফলে মেসিকে দেখাই যায়নি গ্যালারি থেকে। তখনই রাগে গ্যালারির চেয়ার উপড়ে মাঠে ছুড়তে শুরু করেছিলেন দর্শকেরা। চিৎকার করে কেউ কেউ বলতে থাকেন, ‘‘অরূপ কি নিজের বাড়িতে ব্যক্তিগত অতিথি নিয়ে এসেছেন? মেসিকে এ ভাবে জড়িয়ে আছেন কেন?’’ একসময় হাজার হাজার দর্শক ঢুকে পড়েন মাঠের ভিতর। পুলিশকেও তাড়া করেছিল জনতা। হাতের কাছে যে যা পেয়েছেন, ছুড়ে মেরেছেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে শেষ পর্যন্ত মাঠে র‌্যাফ নামাতে হয়। পুলিশ লাঠিচার্জ করে। সব মিটতে দেড় ঘণ্টারও বেশি সময় লেগেছে। এমনকি, তার পরেও স্টেডিয়ামের বাইরে সল্টলেকের রাস্তায় বিক্ষিপ্ত অশান্তি চলেছে।

মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের সঙ্গে লিয়োনেল মেসি।

মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের সঙ্গে লিয়োনেল মেসি। —নিজস্ব চিত্র।

দর্শকদের একাংশের বক্তব্য, কয়েক মিনিটের জন্য হলেও যদি মেসিকে ন্যূনতম নিরাপত্তা দিয়ে মাঠের মাঝে নিয়ে যাওয়া হত, সকলকে অন্তত চোখের দেখা দেখতে দেওয়া হত, মেসি গ্যালারির দিকে হাত নেড়ে কোনও বার্তা দিতেন, তাহলেই টিকিটের অর্থ উসুল হয়ে যেত। কিন্তু তার পরিবর্তে শনিবার সকাল থেকে দেখতে হয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং প্রাক্তন ফুটবলারদের খেলা। মেহেতাব হোসেন, শিল্টন পাল, অসীম বিশ্বাসদের ‘বুড়ো’ হাড়ে কোনও ভেলকি ছিল না। হাজার হাজার টাকার টিকিটের কাছে তা নিতান্তই ছেলেখেলা। অনেকে মাঠে গিয়েছিলেন মেসির পাশে বলিউড বাদশা শাহরুখ খানকে দেখতে। তাঁরাও হতাশ হয়েছেন। কারণ, মেসির সঙ্গে হোটেলেই দেখা করে নেন সপুত্র শাহরুখ। তাঁকে মাঠে দেখাই যায়নি। দেখা যায়নি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কেও। তিনি কিছু ক্ষণের জন্য মাঠে ছিলেন, পরে বেরিয়ে গিয়েছেন। অর্থাৎ, দাদা, দিদি, বাদশার বিজ্ঞাপন দিয়ে মেসিময় যুবভারতীর যে উন্মাদনা তৈরি করা হচ্ছিল, সেখানেও ধোঁকা। এ ব্যবস্থাপনা, পরিকল্পনার অভাব ছাড়া আর কী?

অনেকে ২০১১ সালের স্মৃতি হাতড়াচ্ছেন। সে বছর প্রথম বার কলকাতায় এসেছিলেন মেসি। এই যুবভারতীতেই ম্যাচ খেলেছিলেন। তখনও তাঁকে নিয়ে তিলোত্তমার উন্মাদনা কম ছিল না। কিন্তু এই পরিস্থিতি তো তৈরি হয়নি! কুণাল ঘোষ যেমন লিখেছেন, মেসিকে ঘিরে ছিল ‘হ্যাংলামির ভিড়।’ ২০১১ সালে এই যুবভারতীতেই তিনি মেসির খেলা দেখেছেন। সে দিন কোনও ‘বাড়াবাড়ি’ হয়নি।

কথা ছিল, সাড়ে ১২ ঘণ্টা কলকাতায় থাকবেন মেসি। দুপুর ১২টা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত সেলিব্রিটি ফ্রেন্ডলি ম্যাচ, সংবর্ধনা এবং সংক্ষিপ্ত আলাপ পর্বের সূচি তৈরি করা হয়েছিল। কোথায় কী! মেসিকে ঘিরে থাকা প্রভাবশালীদের ওই ছোট্ট ভিড়ই দিনের শেষে যুবভারতীর ‘ভিলেন’। মেসিকে কাছছাড়া না করে দর্শকদের হতাশা, ক্ষোভে ঘি ঢেলেছেন অরূপ, শতদ্রুরা। ক্ষোভের আগুন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে সমাজমাধ্যমে। মুখ্যমন্ত্রী দুঃখপ্রকাশ করলেও সেই আগুন নিবছে না। ঘটনার পর মমতা ক্ষমা চেয়েছেন মেসির কাছে। দর্শকদের কাছেও। কেন এই পরিস্থিতি তৈরি হল, তা জানতে একটি তদন্ত কমিটিও গড়ে দিয়েছেন। কিন্তু পরিস্থিতি এমন, মমতার সেই পোস্টের নীচে গিয়ে লোকজন টিকিটের টাকা ফেরত চাইছেন।

মেসি নিজে অবশ্য এ সব থেকে অনেক দূরে। তাঁর ঝটিতি সফরের ঠাসা সূচি। ফুটবলের মক্কা ছেড়ে বিমান হায়দরাবাদের উদ্দেশে রওনা দিয়ে দিয়েছে।

Lionel Messi Yuva Bharati Krirangan
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy