বিধি-ভঙ্গ: রবিবার ব্রিগেডে সভার আগে রান্না। নিজস্ব চিত্র।
গঙ্গাসাগর মেলা হোক কিংবা রাজনৈতিক সভা। ব্রিগেড-সহ ময়দান এলাকার সঙ্গে আগুনের সম্পর্ক বোধহয় ছিন্ন হওয়ার নয়! কারণ, ধর্মীয় বা রাজনৈতিক যে কোনও কারণে ময়দানে জন-সমাবেশ হলে সেখানে আগুন জ্বলবেই। অথচ ময়দানের খোলা জায়গায় আগুন জ্বালানো নিষিদ্ধ—বছর চোদ্দ আগে এক মামলার প্রেক্ষিতে এমনটাই রায় দিয়েছিল কলকাতা হাইকোর্ট। কিন্তু সেই রায় অগ্রাহ্য করে প্রতিটি জন-সমাবেশেই ময়দান যেন ‘পিকনিক’ চত্বর হয়ে ওঠে!
যেখানে অস্থায়ী ভাবে গ্যাস, স্টোভ বা উনুনে রান্না করা হয়। অন্য দিকে, আবার প্রবল উৎসাহে পাত পেতে খাওয়ার ‘উৎসব’ চলে। যেমনটা রবিবারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর জন-সমাবেশে হল। এমনিতেই এ শহরের সবুজের শতকরা হার কমতে কমতে বিপজ্জনক জায়গায় পৌঁছেছে। সেখানে শহরের ‘ফুসফুস’ ময়দানেও পরিবেশ-বিধি লঙ্ঘিত হলে পরিবেশ নিয়ে কোনও কথা বলা বা প্রতিশ্রুতি দেওয়ার নৈতিক অধিকার রাজনৈতিক দলগুলির রয়েছে কি না, সেই প্রশ্ন তুলছেন পরিবেশবিদেরা। এক পরিবেশবিজ্ঞানীর কথায়, ‘‘রাজনৈতিক দলগুলো এত বড় বড় কথা বলে, উন্নয়ন, সচেতনতা-সহ সব বিষয়ে তাদের এত জ্ঞান, সেখানে পরিবেশের ক্ষেত্রে এই ঔদাসীন্য কেন?’’
ময়দানকে বাঁচাতে দূষণ নিয়ন্ত্রণ, বেআইনি পার্কিং রোধ নিয়ে গত ডিসেম্বরেই কলকাতা হাইকোর্ট স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে মামলা দায়ের করে। হাইকোর্টের তরফে দুই সদস্যের একটি কমিটিও তৈরি করে দেওয়া হয়। কমিটিতে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল এবং রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল (এজি) রয়েছেন।
রাজ্য প্রশাসন সূত্রের খবর, ইতিমধ্যেই সরকারের তরফে ব্রিগেড-সহ ময়দানের দেখভালের রূপরেখা সংক্রান্ত প্রস্তাব রিপোর্টের আকারে এজি-র মাধ্যমে হাইকোর্টে জমা দেওয়া হয়েছে। সেই প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ময়দান সংলগ্ন রাস্তাঘাট সাফাইয়ের দায়িত্ব পূর্ত দফতর নেবে। ময়দান চত্বর সাফাইয়ের দায়িত্ব কলকাতা পুরসভা নেবে। কিন্তু ময়দানে কেন আদালতের নির্দেশ লঙ্ঘন করে আগুন জ্বালানো হল, সে সম্পর্কে কোনও তরফেই কোনও সদুত্তর পাওয়া যায়নি।
সেনাবাহিনীর তরফে এ বিষয়ে জানানো হয়েছে, ময়দান ব্যবহারের জন্য নো অবজেকশন সার্টিফিকেট (এনওসি) পুলিশ এবং কলকাতা পুরসভাকে দেওয়া হয়েছে। সেখানে আইনশৃঙ্খলার দায়িত্ব পালনের কাজ পুলিশ কর্তৃপক্ষের। এ বিষয়ে জানতে পুলিশের এক শীর্ষ কর্তাকে ফোন করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। উত্তর দেননি মেসেজেরও। বিজেপি নেতা জয়প্রকাশ মজুমদার অবশ্য জানাচ্ছেন, দূর-দূরান্ত থেকে আসা সাধারণ মানুষ সেখানে রান্না করেছেন। কিন্তু তাই বলে কি হাইকোর্টের রায় লঙ্ঘনের ছাড়পত্র পাওয়া যায়? জয়প্রকাশবাবুর বক্তব্য, ‘‘সেটা একদমই নয়। কিন্তু অনেক সময়েই সাধারণ মানুষের চাহিদা বা পরিস্থিতির সঙ্গে পরিবেশের স্বার্থরক্ষার একটা সংঘাত তৈরি হয়। সেই সংঘাতের পথ মসৃণ করে আদালতের রায়ের মান্যতা দেওয়াটাই আমাদের লক্ষ্য।’’
রাজ্যের ক্ষমতাসীন শাসকদলের এক শীর্ষ নেতা আবার বলছেন, ‘‘কলকাতা হাইকোর্টের রায়ের অবশ্যই মান্যতা দেওয়া উচিত। বিশেষ করে পরিস্থিতি এখন যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, সেখানে পরিবেশ নিয়ে সচেতনতা খুবই জরুরি।’’ কিন্তু তাঁর দলের বিরুদ্ধেও পরিবেশ-বিধি লঙ্ঘনের যে অভিযোগ উঠছে? সে সম্পর্কে অবশ্য কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বাম-কংগ্রেসের ব্রিগেড সমাবেশেও একই ভাবে আগুন জ্বালানো হয়েছিল বলে অভিযোগ রাজ্য প্রশাসনের একাংশের। যদিও সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী বলছেন, ‘‘আমাদের তরফে কর্মী-সমর্থকদের রুটি দেওয়া হয়। এ বার রুটি বা চা গরমের জন্য কেউ আগুন জ্বালানোর কোনও ব্যবস্থা করেছেন কি না, সেটা বলতে পারব না। তবে স্টোভ বা উনুন জ্বালিয়ে রান্না বলতে যা বোঝায়, আমাদের ব্রিগেডে তা করা হয়নি।’’ ময়দানের দূষণ সংক্রান্ত বিষয়ে একাধিক মামলা করেছিলেন পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত। তাঁর কথায়, ‘‘ময়দানে উনুন বা স্টোভ জ্বালিয়ে রান্নার ব্যাপারে আগেও পুলিশ-প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছু হয়নি।’’
যার পরিপ্রেক্ষিতে এক পরিবেশকর্মীর বক্তব্য, ‘‘মোদ্দা কথা হল, ময়দানের সঙ্গে আগুনের সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার নয়। ময়দানে জন-সমাবেশ হলে আগুন জ্বালানো হবেই! এটাই নিয়ম হয়ে গিয়েছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy