Advertisement
০৫ মে ২০২৪

কম্পন জাগে শঙ্কার

ঠিক যেন হপ্তা দুই আগের ঘটনার ‘অ্যাকশন রিপ্লে’। তবে নেপালের বিপর্যয়ের পরে আতঙ্কের বহর এ বার আরও বেশি। মঙ্গলবার শহর জুড়েই আতঙ্ক ও প্রাণ বাঁচানোর মরিয়া ভঙ্গির রকমফের। নিউ মার্কেটের কাছে কলকাতা পুরসভাতেও রীতিমতো কোমর বেঁধে দৌড়ের দৃশ্য। জরুরি বৈঠক ছেড়ে পুর-কমিশনার খলিল আহমেদ বারান্দায় প্রাণপণে ছুট দিয়েছেন।

মহানগরের মেদিনী তখন কম্পমান। প্ল্যাটফর্মে থেমে গিয়েছে মেট্রোর চাকা। বেরিয়ে আসছেন আতঙ্কিত যাত্রীরা। মঙ্গলবার কালীঘাট স্টেশনের এই ছবি ধরা পড়ল দেশকল্যাণ চৌধুরীর ক্যামেরায়।

মহানগরের মেদিনী তখন কম্পমান। প্ল্যাটফর্মে থেমে গিয়েছে মেট্রোর চাকা। বেরিয়ে আসছেন আতঙ্কিত যাত্রীরা। মঙ্গলবার কালীঘাট স্টেশনের এই ছবি ধরা পড়ল দেশকল্যাণ চৌধুরীর ক্যামেরায়।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ১৩ মে ২০১৫ ০২:৫৪
Share: Save:

ঠিক যেন হপ্তা দুই আগের ঘটনার ‘অ্যাকশন রিপ্লে’। তবে নেপালের বিপর্যয়ের পরে আতঙ্কের বহর এ বার আরও বেশি।

মঙ্গলবার শহর জুড়েই আতঙ্ক ও প্রাণ বাঁচানোর মরিয়া ভঙ্গির রকমফের। নিউ মার্কেটের কাছে কলকাতা পুরসভাতেও রীতিমতো কোমর বেঁধে দৌড়ের দৃশ্য। জরুরি বৈঠক ছেড়ে পুর-কমিশনার খলিল আহমেদ বারান্দায় প্রাণপণে ছুট দিয়েছেন। ধর্মতলার কাছের পাঁচতারা হোটেলে সাংবাদিক সম্মেলনের আসরে হঠাৎ দেখা গেল, টেবিলে সাজানো ফুল ভাসানোর সুদৃশ্য পাত্রে জল উথলে উঠছে। সঙ্গে সঙ্গে সকলকে বাইরে পুলসাইডে নিয়ে যাওয়া হল। দুপুরে ক্যামাক স্ট্রিটে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরতে ফিরতে কয়েক জন স্কুলবালিকার জোর আলোচনা! কী ভাবে ক্লাস বন্ধ করে সকলকে খেলার মাঠে নামিয়ে আনা হয়েছিল। বাইপাসের ধার থেকে দক্ষিণ কলকাতা জুড়ে শপিং মলেও বাইরে বেরোনোর জন্য হুটোপাটি। দেখা গেল, ফুডকোর্টে স্যান্ডউইচ, মুরগি ভাজা ফেলেই অনেকে পালিয়েছেন প্রাণভয়ে।

প্রাথমিক আতঙ্কের ঝটকার পরে খবরের আপডে়টে ভূমিকম্পের উৎস কোথায় জানতে ব্যস্ত হয়েছে শহর কলকাতা। খুব বড়সড় ভাঙচুরের খবর নেই শহরের নতুন-পুরনো কোনও বহুতলে। লোকাল ট্রেনে বোমা ফেটে বিস্ফোরণে রক্তাক্ত মুখ দেখে দিনটা শুরু হয়েছিল কলকাতার। দুপুরে ভূমিকম্পের ঝাঁকুনির পরে বিমূঢ় শহরবাসী সোশ্যাল মিডিয়ায় মুখর! ‘কী যে হচ্ছে চারপাশে! ঘরে-বাইরে কোথাওই যে আর নিশ্চিন্তে থাকা যাচ্ছে না!’

সদ্য কাঠমান্ডু ফেরত বেলগাছিয়ার সঞ্চিতা পাত্রের হাত-পা কিছু ক্ষণের জন্য ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। সে বার নেপালের রাজধানীর চিনাবাজারে ছেলেমেয়েকে নিয়ে কেনাকাটার সময়ে শুকনো ডাঙায় হুমড়ি খেয়ে পড়ার অভিজ্ঞতা এ যাত্রায় হয়নি ঠিকই, তবে হাঁটুর কাছটা কেঁপে ওঠা এবং মাথা ঘোরার চেনা অনুভূতির মানে বুঝতে ভুল হয়নি এই গৃহবধূর।

দুপুরে ডাল রাঁধতে রাঁধতেই সঞ্চিতাদেবী টের পান, রান্নাঘরের তাকে রাখা মশলার কৌটোগুলো দুলে উঠেছে। একই সময়ে খাস নবান্নের বারোতলায় রাজ্যের অর্থমন্ত্রী, কৃশকায় অমিত মিত্রও ভূমিকম্পে দুলে উঠেছেন। ‘‘ঠিক যেন বাঁশ গাছের মতো দুলছিল বাড়িটা! তবে ভাবছিলাম, বাঁশ গাছ তো ভাঙে না, শুধু দোলে!’’ বারোতলার সিঁড়ি ভেঙে প্রাণপণে নীচে নামার পরে বলছিলেন ওই প্রবীণ মন্ত্রী। বেলগাছিয়ার সঞ্চিতাদেবীও ছেলেমেয়েকে নিয়ে মুহূর্তে বাড়ি ছেড়ে খোলা আকাশের নীচে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন।

ভূমিকম্পের মানেটা ঠিক কী, গত ক’দিনে কলকাতাও হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। বাড়ি বা অফিস থেকে ছুট্টে বেরিয়েই স্মার্টফোনে চোখ রেখে খবরের আপডেটের জন্য লোকে হন্যে হয়ে উঠেছে। আর এই উৎকণ্ঠাই যেন মিলিয়ে দিয়েছে আকবর বাদশা থেকে হরিপদ কেরানিকে।

রাজ্যে ক্ষমতার ‘হট সিট’ নবান্নের সিঁড়িতে প্রাণ হাতে নিয়ে ছুটতে থাকা জনতার মধ্যে তাই দেখা গেল মন্ত্রী-আমলা-পুলিশ-সাধারণ কর্মী— সক্কলে একাকার।

টাটকা ঝাঁকুনির ঠিক পরে দুপুর পৌনে একটায় নবান্ন-লাগোয়া চত্বর দেখলে মনে হবে যেন জমজমাট মেলা বসেছে। কে নেই সেই ভিড়ে! মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখন কলকাতার বাইরে। এর মধ্যে কোনও ভূমিকম্পের সময়েই তিনি নবান্নে ছিলেন না। তবে এ দিনও ফোনে খবর নিয়েছেন। শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু ও কৃষিমন্ত্রী বেচারাম মান্নাকে দেখা গেল শশব্যস্ত হয়ে নীচে নেমে ঘুরঘুর করছেন। বেচারামকে পুলিশের কে এক জন ‘স্যার বসুন’ বলে একটি চেয়ার এগিয়ে দিলেন! মন্ত্রী বলছিলেন, ‘‘মনে হচ্ছিল, চেয়ার থেকে কে যেন ঠেলে ফেলে দিচ্ছে!’’ ১৪তলার ঘর থেকে তড়িঘড়ি নেমে এসে স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়কেও দেখা গেল, মোবাইল ফোনে গম্ভীর মুখে কারও সঙ্গে কথা বলছেন।

ভূমিকম্পের সঙ্গে সঙ্গেই স্মার্টফোনে পরপর ফেসবুক আপডেট আসতে শুরু করলেও ফোনে প্রিয়জনের সঙ্গে কথা বলা ছিল এক ঝকমারি! মোবাইল পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলির দাবি, গত মাসে ২৫ এপ্রিলের ভূমিকম্পের মতোই এ দিনও ফোনে লাইন পেতে ঝামেলায় পড়তে হয়।

বাড়িতে বৃদ্ধ মা-বাবা না স্কুলে বাচ্চারা— কার খবর নেবেন ভেবে জেরবার চাকুরে গৃহস্থেরা।

ভূমিকম্পের ঠিক পরেই টাটা সেন্টারের বহুতলটির সামনে দেখা গেল, বিশাল জটলা। ফোনে প্রিয়জনকে ধরার চেষ্টার মাঝেই আতঙ্ক, ‘না, বাবা আজ আর কিছুতে উপরে উঠে অফিসে ঢুকছি না!’ জনৈক রোগাটে বৃদ্ধ দেখা গেল, দেওয়ালে হেলান দিয়ে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছেন। পেশায় পুরুতঠাকুর। বিভিন্ন অফিসে পুজো করতে আসেন। কে এক জন তাঁকে দেখিয়ে বললেন, ‘‘৮০-র উপরে বয়স, তবু সিঁড়ি দিয়ে ছুটে নেমেছেন!’’

কম্পন-আতঙ্কের একই চিত্র বিমানবন্দর থেকে পাতাল রেল, হাসপাতাল, সিনেমা হলে। পরের বিমানটি নামতে তখন ঠিক মিনিট কুড়ি রয়েছে হাতে। অতএব রানওয়েতে কোনও রকম ফাটল ধরেছে কি না, খুঁটিয়ে পরীক্ষা করা হল। সব কিছু ঠিকঠাক থাকায় বিমানবন্দরের স্বাভাবিক নির্ঘণ্টে হেরফের হয়নি। মেট্রো রেল অবশ্য তড়িঘড়ি পরিষেবা বন্ধ করে দেয়। ট্রেন ঢুকতেই মহাত্মা গাঁধী রোড, পার্ক স্ট্রিট বা মহানায়ক উত্তমকুমার স্টেশনে মাইকে ঘোষণা শোনা যায়, ভূমিকম্প হয়েছে ‘তাই মেট্রো বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।’ সঙ্গে সঙ্গে উপরে ওঠার হুড়োহুড়ি। আধ ঘণ্টা বাদে মেট্রো পরিষেবা ক্রমশ স্বাভাবিক হয়। বিভিন্ন হাসপাতাল সূত্রে খবর, দুপুরের দিকে কয়েকটি অস্ত্রোপচার শুরুর আগে ঝাঁকুনিতে কাজকর্ম ব্যাহত হয়।

নিউ টাউনের অ্যাকশন এরিয়া টু-এর একটি মাল্টিপ্লেক্সে ‘পিকু’ দেখতে দেখতেও কেউ ভয়ে বেরিয়ে আসেন। আইটি কর্মী রক্তিম বাগচী বলছিলেন, ‘‘মনে হচ্ছিল, পর্দায় অমিতাভ যেন কাঁপছেন।’’ তবে ভয়ে দর্শকদের কেউ কেউ বেরিয়ে গেলেও শো কিন্তু বন্ধ হয়নি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE